Advertisement
E-Paper

নেতাই বটে

দর্শকরা শাশুড়ি-বৌয়ের ঝগড়া চাহিতেছেন, না কি নায়কের আর একটি বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান, তাহার উপর নির্ভর করিয়া নাকি টেলিভিশনের সান্ধ্য সিরিয়ালের গল্পের গতিপথ প্রায়শ বদলায়

সম্পাদকীয় ১

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ০০:২২

নরেন্দ্র মোদী অবাক বিস্ময়ে বলিতে পারেন, তিনি কে এবং কী, তাহা জানিয়াই যখন দেশবাসী তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসাইয়াছে, এখন তবে তিনি আর কত নীচে নামিতে পারেন, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা কেন? কথাটি মিথ্যা নহে। কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে তিনি যাহা বলিতেছেন, যে ভঙ্গিতে বলিতেছেন, প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারেই তিনি ঠিক সেই কথাগুলিই, ঠিক সেই ভঙ্গিতেই বলিয়া আসিয়াছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পূর্বেও বলিয়াছেন। উত্তরপ্রদেশে বলিয়াছেন, বিহারেও। তিনি, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী, এই রকমই। বিস্মিত যদি হইতেই হয়, তবে তাহার কারণটি ভিন্ন— সাত দশকের স্বাধীনতা এ কেমন দেশ তৈরি করিল, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে এমন অসংযতবাক, ব্যক্তি-আক্রমণে বিশ্বাসী এক রাজনীতিকই দেশবাসীর পছন্দ? এ কেমন ভারত, যাহা প্রধানমন্ত্রীর মুখে ক্রমাগত বিষোদ্গার শুনিয়াও লজ্জায় মাটিতে মিশিয়া যাইতে চাহে না, আত্মধিক্কারে কাতর হয় না, বরং একের পর এক জনসভায় হাততালিতে ফাটিয়া পড়ে? মোদীই কি এই দেশের যোগ্য প্রধানমন্ত্রী নহেন? মনমোহন সিংহ অন্য ভারতের প্রতিনিধি। যে ভারত একদা গাঁধীর ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, নেহরুর ছিল। অনুমান করা চলে, ভারতের পাল্টাইয়া যাওয়া তিনি বিশ্বাস করিতে পারেন নাই। প্রধানমন্ত্রী সারমেয়ের নিকট দেশপ্রেমের শিক্ষা লওয়ার সুপরামর্শ দিবেন, এবং তাহাতেও মানুষ বিচলিত হইবে না— এই ভারত, অনেকের ন্যায়, তাঁহারও অচেনা।

দর্শকরা শাশুড়ি-বৌয়ের ঝগড়া চাহিতেছেন, না কি নায়কের আর একটি বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান, তাহার উপর নির্ভর করিয়া নাকি টেলিভিশনের সান্ধ্য সিরিয়ালের গল্পের গতিপথ প্রায়শ বদলায়। নরেন্দ্র মোদীও বলিতে পারেন, মানুষ যাহা শুনিতে চাহে, তিনি তাহাই শুনাইতেছেন। বিপণনে সফল হওয়ার ইহাই তো প্রাথমিক শর্ত। গণতন্ত্রে কোনও নেতার, বিশেষত দেশের প্রধানমন্ত্রীর, ভূমিকা ও দায়িত্ব যে সিরিয়ালের পরিচালক অথবা তেল-সাবানের বিপণনকারীর অপেক্ষা ভিন্ন এবং গুরুতর, নরেন্দ্র মোদী তাহা স্বীকার না-ই করিতে পারেন। কারণ, তাঁহার রাজনৈতিক জীবনে গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার নিরিখে সংসদ ভবনকে সাষ্টাঙ্গ প্রণামের আর কোনও পূর্বাপর নাই। তিনি ভোটের ব্যাপারী। সেই ভোট যদি সাম্প্রদায়িক বা অন্যবিধ তিক্ততার মূল্যে আসে, তাহাও সই। আর, যদি প্রধানমন্ত্রীর কুর্সির সম্মানের মূল্যে আসে, তাহাও সমান গ্রহণযোগ্য। তিনি ক্ষমতার পূজারি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মাহাত্ম্যের নহে।

অতএব অনুমান করা চলে, প্রধানমন্ত্রী হইবার পর যে তাঁহার মুখের ভাষায়, অথবা মনের ভাষায়, কোনও পরিবর্তন সাধন করা প্রয়োজন, নরেন্দ্র মোদী তাহা মনে করেন নাই। তিনি আমিত্ববাদী। ফলে, কোনও কুর্সির পরিচয় যে তাঁহার ব্যক্তি-পরিচয়ের অনেক ঊর্ধ্বে হইতে পারে, সেই কুর্সিতে বসিতে হইলে নিজের ‘আমি’-কে চৌকাঠের বাহিরে ছাড়িয়া আসিতে হয়, তিনি সেই কথাটিতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু প্রশ্ন, তাঁহার সেই ‘আমি’-টিকে স্বয়ং তিনিও কি যথেষ্ট সম্মান করেন? নিজের উপর তাঁহার কি সেই বিশ্বাস আছে, যাহার জোরে জনতাকে তাহার ভুল চাওয়া হইতে সরাইয়া উচ্চতর রাজনীতির পথে লইয়া যাইতে পারেন? তাহাই নেতার কাজ। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী সেই নেতা নহেন। যে ‘আমি’-তে তিনি মুগ্ধ, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহাও সারহীন প্রতিফলনমাত্র। জনতা যাহা চাহে, অন্তত প্রধানমন্ত্রী যাহাকে জনতার চাহিদা হিসাবে জানেন এবং বিশ্বাস করেন, সেই চাহিদার প্রতিফলন। তিনি মানুষের চাহিদা মাপিয়া নিজের ‘আমি’-কে গড়িয়া লইয়াছেন। সেই ‘আমি’-র সাধ্য কী, জনতাকে নূতন, উচ্চতর, পথে চালনা করিতে পারে।

Power Narendra Modi identity
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy