ফাইল চিত্র।
ডিক্রির মাধ্যমে শাসন অনেকেই করিয়াছেন। বেনিতো মুসোলিনি হইতে উগো চাভেজ। ইন্দিরা গাঁধীও। নরেন্দ্র মোদীও করিয়া থাকেন। তবে ফারাক, তাঁহার অস্ত্র অধ্যাদেশ। আরও ফারাক, নরেন্দ্র মোদীকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিতে হয় নাই। তাঁহার জমানায় ‘স্বাভাবিক অবস্থা’-তেই গণতন্ত্রকে থাড়াই কেয়ার করিবার রীতি হইয়াছে। মোদী যেহেতু বারে বারেই জরুরি অবস্থার বিপদের কথা স্মরণ করাইয়া দেন, তাঁহাকেও তাঁহারই সৃষ্ট ‘স্বাভাবিক অবস্থা’-র বিপদের কথা মনে করাইয়া দেওয়া বিধেয়। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই কাজটিই করিয়াছেন। আলোচনা এড়াইয়া, সংসদকে পাশ কাটাইয়া অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন যে গণতন্ত্রের পরিপন্থী, এবং সেই কারণেই এই পথটি পরিত্যাজ্য, তাঁহার বিদায়ী ভাষণে প্রণববাবু তাহা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলিলেন। তাঁহার মতে, সরকার যদি সংসদকে এড়াইয়া যায়, তবে তাহা দেশের মানুষের বিশ্বাসভঙ্গের শামিল। প্রণববাবুর বক্তব্যে অস্বস্তি বোধ করিবার কারণ নরেন্দ্র মোদীর বিলক্ষণ আছে। যতই তিনি ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া তবে সংসদ ভবনে প্রবেশ করুন, সংসদীয় গণতন্ত্রে যে তাঁহার আস্থা নাই, গত তিন বৎসরে তিনি কথাটি বহু বার প্রমাণ করিয়াছেন। চিনের সহিত ভারতের তুলনা করিবার ক্ষেত্রে একটি অশিক্ষিত বিশ্বাস প্রায়শ উচ্চারিত হইয়া থাকে— গণতন্ত্রের সহিত দ্রুত উন্নয়নের প্রত্যক্ষ বিরোধ রহিয়াছে, ফলে উন্নয়নকে গতিশীল করিতে হইলে গণতন্ত্রকে জায়গা ছাড়া চলিবে না। আশঙ্কা হয়, নরেন্দ্র মোদীও এই কথাটিতে বিশ্বাস করেন। প্রণববাবু যখন ঠিক সে দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করিলেন, নরেন্দ্র মোদী কি নিজের ভুল দেখিতে পাইলেন?
প্রণববাবু কোনও নূতন কথা বলেন নাই— গণতন্ত্রের প্রধানতম সত্যটিকেই ফের স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন মাত্র। আলোচনার মাধ্যমে, বিভিন্ন মতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, নীতি প্রণয়ন করাই গণতন্ত্রের মৌলিক ধর্ম। সেই মতের মধ্যে বিরুদ্ধস্বর থাকাই স্বাভাবিক, বস্তুত বাঞ্ছনীয়। কারণ, সেই বিরুদ্ধস্বর দেশের সেই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, যাঁহারা সরকারের সমর্থক নহেন। সরকারের বিরোধী হইলেও দেশের নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়ায় তাঁহাদের মতামত একচুলও কম বৈধ নহে। ফলে, নীতিতে সেই মতের প্রতিফলন ঘটাও জরুরি। সংসদে আলোচনা হইলে সেই বিরুদ্ধ মতগুলি নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। অধ্যাদেশে ধরা থাকে শুধু সরকারের কণ্ঠস্বর। বিরোধীদের সহিত আলোচনার পরিসরটিকে নষ্ট করিয়া ফেলিলে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা মানুষের কণ্ঠস্বরও রোধ করা হয়। তাঁহারা নির্বাচনে অংশ লইয়াছিলেন দেশের নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়ায় নিজেদের মতের অস্তিত্ব নিশ্চিত করিবার জন্যই। অধ্যাদেশ তাঁহাদের সেই অধিকার কাড়িয়া লয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বড় বেশি সময়সাপেক্ষ, এহেন একটি অযৌক্তিক বিশ্বাস ভারতীয় রাজনীতিতে রহিয়াছে। আলোচনা যদি সদর্থক হয়, শাসকরা যদি বিরোধী পক্ষের কথা শুনিতে সত্যই আগ্রহী হন, তবে সেই আলোচনা দীর্ঘসূত্র হইবার কোনও কারণ নাই। সহযোগিতায় সময় নষ্ট হয় না, হয় অসহযোগিতায়। বিরোধীরা যখন সংসদ অচল করিয়া রাখিতে মনস্থ করেন, তখনই সময় বহিয়া যায়, কিন্তু কাজ আগায় না। বিরোধীদের দায় আছে, সে কথা বিদায়ী রাষ্ট্রপতিও স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু, এই ক্ষেত্রেও প্রকৃত দায় সরকারপক্ষের। শুধু দায়ে পড়িলেই নহে, বিরোধীদের সহিত আদানপ্রদানের পরিসরটি যে সর্বদাই খোলা রাখিতে হয়, এবং একমাত্র তবেই সহযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভে কথাটি শাসকরা হামেশাই ভুলিয়া যান। ফলে, অধ্যাদেশকেই ‘স্বাভাবিক পন্থা’ বলিয়া মানিতে হয়। গণতন্ত্রের অপমানই এই রাজনীতির একমাত্র পরিণতি হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy