—ফাইল চিত্র
রামমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এই বাক্যটিকে অন্য ভাবেও লেখা সম্ভব: ভারত নামক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক প্রধান একটি ধর্মের মন্দির স্থাপনের প্রক্রিয়াটিতে সচেতন ভাবে অংশীদার হইয়াছেন। এবং, মন্দিরটিও যে কোনও মন্দির নহে— পাঁচ শতাব্দী-প্রাচীন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিয়া সেই জমিতে স্থাপিত হইতেছে রামমন্দির। অর্থাৎ, যে মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের বহু ভাষ্যকার ‘ধর্মনিরপেক্ষ, সর্বজনীন’ ভারতের পরিসমাপ্তি হিসাবে দেখিতেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রধানতম রক্ষাকর্তা দেশের রাষ্ট্রপতি সেই মন্দির নির্মাণেই টাকা দান করিলেন। দুর্ভাগ্যজনক। স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক যে, সন্ন্যাস গ্রহণের সময় যেমন পূর্বাশ্রম সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইতে হয়, রাষ্ট্রপতির কুর্সিটিও তাহাই দাবি করে। যিনি এক বার দেশের সাংবিধানিক শীর্ষপদে আসীন হইবেন, তাঁহার অতীত থাকিতে পারে না; দেশের সংবিধান ভিন্ন আর কিছুর প্রতি তাঁহার আনুগত্য থাকিতে পারে না; তাঁহার পক্ষপাত থাকিতে পারে না, ঘোষিত কোনও পছন্দ-অপছন্দও থাকিতে পারে না। দেশের রাষ্ট্রপতির পরিচয়টি গ্রহণ করিবার মুহূর্তেই তাঁহার ব্যক্তি-পরিচয় লোপ পায়। ফলে, এই দাবি করিবারও উপায় নাই যে, রামমন্দির নির্মাণকল্পে দানটি রামনাথ কোবিন্দের ব্যক্তিগত, তাহা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর নহে। মন্দির গড়িতে অর্থ দান করিয়া তিনি রাষ্ট্রপতির আসনটিতে এক অনপনেয় কালিমা লেপন করিলেন।
রাষ্ট্রপতিকে কেন পূর্বাশ্রম-বিস্মৃত, পক্ষপাতহীন এক সত্তায় উত্তীর্ণ হইতে হয়? তাহার কারণ, তিনি দেশের প্রতিটি মানুষের নেতা, অভিভাবক— দেশের প্রতিটি মানুষ তাঁহার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতিফলন দেখেন। ফলে, রাষ্ট্রপতি কোনও অর্থেই কোনও গোষ্ঠীর সহিত— ধর্মীয়, ভাষাগত, বা অন্য যে কোনও পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়িয়া উঠা গোষ্ঠীর সহিত— অন্য গোষ্ঠীর তুলনায় অধিকতর ঘনিষ্ঠ হইতে পারেন না। সর্ব গোষ্ঠীর সহিত সমান সম্পর্ক বজায় রাখাও নহে, তাঁহার নিকট সংবিধানের প্রত্যাশা— তিনি সকল গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে বিরাজ করিবেন। কথাটি শুধু ভারতেই নহে, গোটা দুনিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ, গণপ্রজাতান্ত্রিক দেশগুলিতে স্বীকৃত। আমেরিকার সেনেটে ধর্মীয় প্রার্থনার প্রথা বন্ধ হইয়া যায়, কারণ কেহ ধর্মে বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হইলে সেই প্রার্থনা তাঁহাকে বিচ্ছিন্ন করিবে। ইহাই সভ্যতার শর্ত। রামমন্দির নির্মাণে অর্থ দান করিয়া শ্রীকোবিন্দ কি এই কথাই জানাইয়া দিলেন না যে, শুধু রাজনৈতিক বয়ানেই নহে, ভারতের রাষ্ট্রভাবনাতেও এখন অ-হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? রাষ্ট্রপতি নিশ্চয় জানিবেন, এই কথাটি ভারতের সংবিধানেরই অবমাননা করে।
প্রকৃত প্রস্তাবে দায়টি বর্তায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার উপর, প্রধানমন্ত্রীর উপর। রাষ্ট্রপতি তাঁহাদের পরামর্শের দ্বারা চালিত হইবেন, তাহাই নিয়ম। সুতরাং, তিনি মন্দির তহবিলে অর্থ দান করিতে চাহিলে তাঁহাকে নিরস্ত করাই প্রধানমন্ত্রীর কাজ ছিল। তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন নাই। বারণ করা যে তাঁহার দায়িত্ব, প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই কথাটি আদৌ উপলব্ধি করিয়াছিলেন কি না, তাহাও প্রশ্ন বটে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী রাষ্ট্র যে কোনও ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি অধিকতর সহানুভূতিশীল হইতে পারে না, এই কথাটি তিনি আদৌ জানেন বা মানেন কি? ভাবিতে আশ্চর্য লাগে, প্রধানমন্ত্রীর এই কুর্সিতেই একদা বসিতেন জওহরলাল নেহরু। রাষ্ট্রীয় পরিসরে হিন্দু ধর্মানুসারী রীতি অনুসরণ হইতে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে তিনি একাধিক বার নিরস্ত করিয়াছিলেন। ধর্মের প্রতি নেহরুর ব্যক্তিগত বিতৃষ্ণা তাহার কারণ ছিল না। নেহরু জানিতেন, রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম হয় না। বর্তমান শাসকরা এই কথাটি শিখিয়া লইতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy