Advertisement
E-Paper

যুক্তি-তর্কের পরিসরটাকেই ক্রমশ সঙ্কুচিত করে আনছেন এঁরা

ময়ূর-শাবকের জন্মরহস্য এ বার নতুন করে উন্মোচিত হল। দেশ জুড়ে যে ছদ্ম-জাতীয়তাবাদের হম্বিতম্বি, তাতে গা ভাসিয়ে এত দিন গরুকে সাধারণ গৃহপালিত পশু থেকে ঐশ্বরিক অস্তিত্বে পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৭ ০৩:৩৪
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ময়ূর-শাবকের জন্মরহস্য এ বার নতুন করে উন্মোচিত হল। দেশ জুড়ে যে ছদ্ম-জাতীয়তাবাদের হম্বিতম্বি, তাতে গা ভাসিয়ে এত দিন গরুকে সাধারণ গৃহপালিত পশু থেকে ঐশ্বরিক অস্তিত্বে পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল। এ বার শুরু হল ময়ূরকে ব্রহ্মচারী প্রমাণ করার প্রবল প্রয়াস। বিজ্ঞান তো বটেই, প্রাথমিক স্তরের যুক্তি-বুদ্ধিকেও অস্বীকার করার চেষ্টা হল। উদ্যোক্তা কে? এক বিচারপতি!

অশ্রুতেই ময়ূরীর সঙ্গে মিলন ময়ূরের— এ তত্ত্বের প্রবক্তা যে আসলে ছদ্ম-জাতীয়তাবাদে আক্রান্ত, তা নিয়ে সংশয় নেই। এই ধরনের মন্তব্যগুলোর মধ্যে এক সাংঘাতিক কূপমণ্ডূকতার নিহিতি। সেই কূপমণ্ডূকতাই আমাদের বলতে শেখায়, বিজ্ঞানের উপরে হল পূরাণ, মানব সভ্যতার চেয়েও প্রাচীন হল ভারত এবং যাবতীয় আবিষ্কারের আদিতে রয়েছে ভারতীয় ঐতিহ্য। গণেশের গ্রীবায় হস্তিমুণ্ডের প্রতিস্থাপনই হল পৃথিবীর প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি, পুষ্পক রথই হল পৃথিবীর প্রথম বিমান, পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত ব্রহ্মাস্ত্রই হল প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র— এ সবও ওই কূপমণ্ডূকতার বয়ান।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, যুক্তির বিসর্জন। যুক্তি-তর্কের পরিসরটাকে ক্রমশ যেন সঙ্কুচিত করে আনা হচ্ছে। অর্থহীন বিভ্রান্তিগুলোয় বিশ্বাস রাখাকে ‘খাঁটি ভারতীয়ত্ব’ নামে ডাকা হচ্ছে। উগ্র এবং অন্ধ জাতীয়তাবাদকে ‘দেশপ্রেম’ বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। মানবজাতির ক্রমবিকাশে বিভিন্ন সভ্যতার যে অনস্বীকার্য অবদান, তাকে বার বার নস্যাৎ করা হচ্ছে।

ময়ূরের জন্মরহস্য সংক্রান্ত যে তত্ত্বের অবতারণা হল এবং যাঁর মাধ্যমে হল, তাতে দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী তথা স্বঘোষিত দেশপ্রেমীরা যে আরও উৎসাহিত হবেন, সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই। গো-সম্পদ রক্ষার নামে যত্রতত্র গণপ্রহার, রক্তপাত ঘটানো, এমনকী প্রাণ নেওয়ার যে প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে, ময়ূর-তত্ত্ব নিশ্চিত ভাবে সে প্রবণতাকেও প্রশ্রয়ই দেবে। আশঙ্কা সেখানেই। ভারতের রাজনীতি, ভারতের সরকার, ভারতের প্রশাসন কতটা স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ অনেক বারই তৈরি হয়েছে। কিন্তু ভারতের বিচার বিভাগ সফল ভাবেই নিজেকে সে সব সংশয়ের অনেক ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছে। দীর্ঘ দিন দেশের সেই বিচার বিভাগেই অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ পদ সামলে আসা ব্যক্তি যখন ময়ূরের ব্রহ্মচর্য প্রমাণে উদগ্র হয়ে ওঠেন, তখন স্তম্ভিত এবং হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

ইতিহাসের সুদীর্ঘ এবং অসীম যাত্রাপথে বিভিন্ন বাঁক আসে। সেই বাঁকগুলোয় পৌঁছে এক বার পিছন ফিরে তাকানোর দরকার পড়ে, এক বার আয়নায় নিজেদের মুখগুলো দেখে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। তেমনই এক বাঁকে উপনীত আজ ভারত। বাঁকটার নানা প্রান্তে নানান মাপের আয়না রাখা রয়েছে। সে আয়নায় আজ সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে এমন কয়েকটা মুখ, যাঁরা সভ্যতার বিপরীতে ছুটতে চান, ভারতকেও সেই বিপ্রতীপ দিশায় টেনে নিয়ে যেতে চান। কেন যাব ওই দিশায়? এই প্রশ্ন তোলার অবকাশ দিতে চান না। যুক্তি-তর্কের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে চান না।

peacock Mythology Judge Mahesh Chandra Sharma Anjan Bandyopadhyay Newsletter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy