বিধানসভার অনুমোদন না লইয়া কী প্রকারে পূজা কমিটিগুলিকে অনুদান দিল রাজ্য সরকার, বিতরণের পদ্ধতিই বা কী, সে প্রশ্নটি সুপ্রিম কোর্ট তুলিতে ভোলে নাই। অর্থ বিতরণ অবৈধ প্রতিপন্ন হইলে টাকা ফিরিয়া পাইবে কী করিয়া, সে প্রশ্নও করিয়াছেন বিচারপতিরা। এই মামলার আবেদনকারীরা অবশ্য আরও একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন। তাহা এই যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পূজার আয়োজকদের কি সরকার অনুদান দিতে পারে? অতঃপর রাজ্য সরকারকে বলা হইয়াছে, ছয় সপ্তাহের মধ্যে তাহার অবস্থান হলফনামায় জানাইতে। সংশয় এই যে, তাহাতেও কি ধর্মের সহিত রাষ্ট্রের সম্পর্ক লইয়া চিন্তা করিবার যথোচিত সূত্র মিলিবে? অনুদান বিতরণের যথার্থ পদ্ধতি লইয়া পর্যবেক্ষণ মিলিবে? যদি না মিলে, তবে কিন্তু নাগরিকের সংশয়ের মীমাংসা হইবে না। ধর্মের সহিত রাষ্ট্রের সম্পর্ক ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রনীতির পাঠ্য, সেই পাঠ্য মািনতে হইলে অনুদান বিতরণের যথার্থ পদ্ধতি লইয়া মাথা ঘামাইবেন আধিকারিক, আর পূজা কমিটিকে আটাশ কোটি টাকা অনুদান যে হেতু সরকারের অর্থ, তাহাতে একটি অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ থাকিবে।
উন্নত দেশে সরকারি অর্থের উপর বহু মানুষের দাবি। তাহার কোনটি সরকার গ্রাহ্য করিবে, সরকারি ভর্তুকি বা অনুদান কে পাইবে, তাহা লইয়া নিত্য টানাপড়েন। ভোটাধিকারে সকল নাগরিক সমান, রাজকোষের অর্থেও সকল নাগরিকের অধিকার রহিয়াছে, কিন্তু সকলের দাবির গুরুত্ব সমান নহে, হইতে পারে না। প্রশ্নটি অগ্রাধিকারের। বৃহৎ শিল্প বা বড় কৃষক কখন অগ্রাধিকার পাইবে, কখন ছোট চাষি কিংবা ক্ষুদ্র শিল্প, তাহা কখনও ক্ষমতার অলিন্দের গোপন আঁতাতে, কখনও নির্বাচনের উন্মুক্ত প্রান্তরে নির্ধারিত হয়। কিন্তু নাগরিক সমাজে ভর্তুকি বা অনুদান পাইবে কে, তাহা নির্ধারণের একটি সহজ উপায় আছে। ভর্তুকি না পাইলে যাহারা অতি-প্রয়োজনীয় পণ্য বা পরিষেবা পাইতে অক্ষম, তাহারাই ভর্তুকি পাইবার অধিকারী। সরকারি সহায়তা না পাইলে যে শৌচাগার বানাইতে পারিবে না, রান্নার গ্যাস কিনিতে পারিবে না, তাহারই ভর্তুকি পাইবার অধিকারী। শিক্ষায় অনুদান না দিলে যাহার সন্তান স্কুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ করিতে পারিবে না, চিকিৎসা বিনা খরচে না দিলে যাহার প্রাণ বাঁচিবে না, তাহারাই অনুদান পাইবার যোগ্য প্রার্থী। আক্ষেপ, এ দেশের লোকে সে যুক্তিটি ভুলিয়াছে। সরকারি সম্পদের দখল করা ক্ষমতার পরিচয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যাহার প্রভাব অধিক, সে অধিক সুবিধা আদায় করিবে। অধিকার হইয়া উঠিয়াছে ‘জোর খাটাইবার অধিকার।’ যাহার পাকা বাড়ি, সে-ও ত্রাণের ত্রিপল ঘরে লইয়া আসে। যাহার দুই-তিনটা গাড়ি, সে-ও রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছাড়িতে নারাজ।
এই মাপকাঠিতে বিচার করিলে স্পষ্ট হইয়া যায়, কেন পূজা কমিটি সরকারি অনুদান পাইবার অধিকারী নহে। সর্বজনীন পূজার আয়োজন আবশ্যক নহে, এবং সরকারি অনুদান না পাইয়াও তাহার আমোদ-আহ্লাদে কখনও টান পড়ে নাই। সরকার অবশ্য নানা কারণ দেখাইয়াছে। যেমন, এলাকা পরিষ্কার করিতে পূজা কমিটিকে অনুদান দিতেছে পুরসভা, পথনিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করিতে টাকা দিতেছে পুলিশ। সরকারি প্রকল্প তবে পূজা কমিটিই সমাধা করিবে? তাহার মূল্যায়ন করিবে কে? পাড়ার ক্লাবগুলিকে ইতিমধ্যেই ছয়শো কোটি টাকা দিয়াছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তাহা নাগরিকের কতটুকু কাজে লাগিয়াছে, আজও তাহা রহস্য। যাহার অধিকার নাই, তাহার দাবি বাড়িতে থাকিলে প্রকৃত দাবিদার কোণঠাসা হইতে বাধ্য। মা-মাটি-মানুষের সরকারের নিকট কোন ‘মানুষ’ গুরুত্বপূর্ণ, সে প্রশ্নটি ঈশান কোণে মেঘের ন্যায় ঘনাইয়া উঠিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy