রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসিলেন, কাজ সারিলেন, চলিয়া গেলেন। বাইশ ঘণ্টার সফরে যে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা যায়, এই সফর তাহার দৃষ্টান্ত হইবার দাবি রাখে। তাহার সঙ্গে, কত কম ঢাকঢোল বাজাইয়া কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারা যায়, তাহারও দৃষ্টান্ত এই সফর তৈরি করিল বইকি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন, কেহই তাঁহাদের বৈঠক-সমাপনকারী বক্তব্যে দুই দেশের মহা-গুরুত্বময় চুক্তি বিষয়ে বিশদ কিছু বলিলেন না। কম কথায় কূটনীতি সাধন রাশিয়ার বহু বৎসরের ঐতিহ্য। এই বারও তাহার ব্যতিক্রম দেখা গেল না। অবশ্য কম কথা ও বেশি কাজের পিছনে আরও একটি আপাত-অদৃশ্য কারণ আছে। তাহার নাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ও রাশিয়ার চুক্তি, বিশেষত সামরিক চুক্তি বিষয়ে ওয়াশিংটন রীতিমতো কড়া নজর রাখিতেছিল, এবং আগেই হুমকি দিয়াছিল যে, দিল্লির তরফে কোনও বেগড়বাঁই দেখিলে ভারতের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবা হইতে পারে। সুতরাং পুতিনের দিল্লি সফরে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি লইয়া বেশি হইচই না হওয়াটাই স্বাভাবিক। দ্বিপাক্ষিক নীরবতার অবকাশে অবশ্যই এই বারের চুক্তিটির বহুমুখী তাৎপর্য ভুলিলে চলিবে না। প্রথমত, আর্থিক গুরুত্বের দিক দিয়া ইহা একটি বৃহৎ মাপের চুক্তি। পাঁচশত চল্লিশ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র, নূতন উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতি, প্রযুক্তি সহায়তার ঘোষণা ইত্যাদি ছাড়াও এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশ নিজেদের বাণিজ্যের পরিধি বাড়াইতে চাহিয়াছে। এখন যাহা এক হাজার কোটি ডলার মূল্যের বাণিজ্যে দাঁড়াইয়া— তাহাকে বিবিধ দিকে চালিত করিবার আলোচনা হইয়াছে। ভারতের পক্ষে ইহার গুরুত্ব অপরিসীম। রাশিয়া ভারতের বহু কালের সমর্থক ও সহায়ক দেশ। পুরাতন গ্রন্থিকে নূতন করিয়া বাঁধিবার মধ্যে একটি আলাদা স্বস্তি আছে। মোদী-পুতিনের এই বারের বৈঠকটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহু দিন পর ভারতকে একটি স্বস্তিবোধের তলে দাঁড় করাইতে পারিল।
দ্বিতীয় গুরুত্বটিও প্রথমটির সহিত অঙ্গাঙ্গি। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া মার্কিন-ভারত মিত্রতার পিছনে দিল্লি অনেক সময় ও শ্রম খরচ করিয়াছে। এই বারের চুক্তিতে প্রমাণ করা গেল যে, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখিবার বোকামি দিল্লি করিতে চাহে না। ঠান্ডা যুদ্ধের দিন গিয়াছে, কিন্তু ছায়া যুদ্ধ এখনও ভারতের মতো দেশের পিছু ছাড়ে নাই। এখনও যে মার্কিন মেরু ও রুশ মেরু ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হইয়া যায় নাই, তাহা এশীয় দেশগুলির কূটনীতির অন্দরমহলে নজর রাখিলেই ঠাহর হয়। রাশিয়ার নিকট হইতে বেশি সহায়তা লইলে ওয়াশিংটন ভারতকে সবক শিখাইতে চাহিতে পারে— এমন ঝুঁকির সামনে দাঁড়াইয়াও মস্কোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য চুক্তি করিয়া ভারত দেখাইয়া দিল, স্বাধীন কূটনীতি পরিচালনার ক্ষমতা ও আত্মপ্রত্যয়, কোনওটিরই কমতি তাহার নাই। বিশেষ করিয়া কমিউনিকেশনস কমপ্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিয়োরিটি এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করিবার এক মাসের মধ্যেই দিল্লির এই স্বাধীন স্ট্র্যাটেজি ছকিবার উদাহরণ বিশ্ব কূটনীতির দরবারে একটি বলিষ্ঠ বার্তা পাঠাইল। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না, মোদী সরকারের একের পর এক কূটনৈতিক ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির মধ্যে রুশ-ভারত চুক্তিটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী। কী ভাবে দুই বৃহৎ শক্তিকে নিজের সুবিধার মুদ্রায় ব্যবহার করিতে হয়, দিল্লির কূটনীতিতে সেই বাস্তববোধই প্রতিফলিত হওয়া উচিত। আশা করা যায়, সেই বাস্তববোধের মধ্যে কত দূর যাওয়া সঙ্গত ও কোথায় থামা সঙ্গত— তাহার নির্ধারণও পড়িতেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন যে হেতু দেশভিত্তিক নিষেধাজ্ঞার বদলে চুক্তিভিত্তিক নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবিতেছে, দিল্লিকে মাথা ঠান্ডা করিয়া, ধৈর্য না হারাইয়া, প্রলোভনে না ভুলিয়া, নিজের প্রয়োজনের পারম্পর্যটি বিবেচনা করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy