Advertisement
E-Paper

কথা রাখেননি রবীন্দ্রনাথ

অধ্যাপক এডওয়ার্ড টমসন পরে হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নানা তর্ক, জটিলতা আর কথা-রাখা-না-রাখায় যে বন্ধুত্বের জুড়ি মেলা ভার। বন্ধুত্বের সূচনাটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আর এক বন্ধু তখনকার বাঁকুড়ার জেলা জজ লোকেন্দ্রনাথ পালিতের সূত্রে। লিখছেন আশিস পাঠকবন্ধুত্বের সূচনাটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আর এক বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের সূত্রে। লোকেন্দ্রনাথ তখন ছিলেন বাঁকুড়ার জেলা জজ। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রসাহিত্যে গভীর পরিচয় টমসনের। 

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ২২:২২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে বাঁকুড়ায় এলেও তা দেখে যেতে পারেননি এডওয়ার্ড টমসন (ইনসেটে)। ফাইল চিত্র

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে বাঁকুড়ায় এলেও তা দেখে যেতে পারেননি এডওয়ার্ড টমসন (ইনসেটে)। ফাইল চিত্র

বাঁকুড়া থেকে ইংরেজ এক অধ্যাপক চলেছেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করবেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু। তার বছর কয়েক আগে অধ্যাপক এসেছেন বাঁকুড়ায়, ওয়েসলিয়ান মেথডিস্ট মিশনের আগ্রহে বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান মিশন হাইস্কুল ও কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে। কিছু দিনের মধ্যেই ভালবেসে ফেলেছেন বাঁকুড়াকে, হয়ে উঠেছেন অসাধারণ জনপ্রিয় শিক্ষক। আর সেখানেই, বাংলা ভাষা শিখতে শিখতে রবীন্দ্র-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়।

ওই অধ্যাপক, এডওয়ার্ড টমসন পরে হয়ে উঠবেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নানা তর্ক, জটিলতা আর কথা-রাখা-না-রাখায় যে বন্ধুত্বের জুড়ি মেলা ভার। বন্ধুত্বের সূচনাটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আর এক বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের সূত্রে। লোকেন্দ্রনাথ তখন ছিলেন বাঁকুড়ার জেলা জজ। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রসাহিত্যে গভীর পরিচয় টমসনের।

বাঁকুড়ায় তখন আধুনিক শিক্ষা একটা গতি পেয়েছে। ১৮৪০-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঁকুড়া জেলা স্কুল, ১৮৮৫-তে ওয়েসলিয়ান মেথডিস্ট মিশনারি সোসাইটির উদ্যোগে কুচকুচিয়ায় একটি স্কুল চালু হয়েছে। এই মিশন স্কুল আর জেলা স্কুল ছাড়াও তৈরি হয়েছে বঙ্গ বিদ্যালয়। কিন্তু এই তিন স্কুলের ছাত্রেরা সে কালের প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রায় পেতই না। বাঁকুড়া বা আশপাশের কোনও জেলায় তখন কোনও কলেজ নেই।

বাঁকুড়া জেলার প্রথম কলেজ সে কালের ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ, আজকের খ্রিস্টান কলেজ। ১৯০৩-এ এগারো জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু থেকে ধরলে আজ কলেজের বয়স ১১৬ বছর। আর বি এ পড়ানো শুরুর শতবর্ষ এ বছর। কিন্তু সাল-তারিখ বড় কথা নয়, এই প্রায় সওয়া শো বছর জুড়ে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা আর ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায় কলেজের ইতিহাস বর্ণময় হয়ে রয়েছে। আর সেই রঙিন ইতিহাসকে ধরে রাখতেই কলেজ থেকে প্রকাশিত হয়েছে একটি সংকলন, বাঁকুড়া খৃশ্চান কলেজ গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি। সম্পাদনা করেছেন কলেজেরই দুই অধ্যাপক মনোরঞ্জন চক্রবর্তী আর অনুপম যশ।

সে ইতিহাসের নানা গল্প, নানা রং, নানা উজ্জ্বল মুহূর্ত। এডওয়ার্ড টমসন আসছেন বাঁকুড়ায়, মাদ্রাজ থেকে কলকাতা হয়ে ট্রেনে। ভোর সাড়ে ৪টেয় নামবেন বাঁকুড়া স্টেশনে। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লণ্ঠন-হাতে অপেক্ষা করছেন খ্রিস্টান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ রেভারেন্ড জন মিচেল। স্টেশনে তখন মালবাহকের কাজ করত মেয়েরা। তাই দেখে অবাক টমসন, পরে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দি ওনলি কুলিজ অ্যাট বাঁকুড়া আর গার্লস’। ভোরের বাঁকুড়াকে তাঁর মনে হয়েছিল চিত্রকরের বিশাল ল্যান্ডস্কেপ। টমসন অল্প দিনের মধ্যেই ছাত্র ও সহকর্মীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।

তার পরে একটু একটু করে বিদেশি হয়েও টমসন একান্ত আপন করে নিলেন বাঁকুড়াকে। এমনকি, সেটা এত দূর পর্যন্ত যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাসে যে সব ক্ষোভের কাঁকর জমেছিল তার একটা বড় কারণ ছিল কথা দিয়েও রবীন্দ্রনাথের বাঁকুড়ায় না আসা।

রবীন্দ্রনাথকে বাঁকুড়ায় নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন টমসন। রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর চিঠিতে সেই আর্তি, ‘ডিয়ার রবিবাবু, ইউ মাস্ট কাম টু বাঁকুড়া, মাই বয়েজ আর লংগিং টু সি ইউ…আই ওয়ান্ট ইউ টু কাম হিয়ার, ইফ ইউ ক্যানন হোয়েন ইট ইজ ফুল মুন’। বছরের পর বছর কেটে গেলেও রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েও বাঁকুড়া না আসার ক্ষোভ অনেক দিন ধরে পোষণ করেছিলেন টমসন।

২৯ জানুয়ারি ১৯১৬ বাঁকুড়া জেলার দুর্ভিক্ষে সাহায্য করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‍‍ফাল্গুনী-র অভিনয় হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে আটচালা বেঁধে রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে, টিকিট বিক্রি করে। রবীন্দ্রনাথ কথা দিয়েছিলেন টমসনকে, ওই অভিনয়ের পরে বাঁকুড়া যাবেন। কিন্তু সে কথা রাখতে পারলেন না। এতটাই ক্লান্ত ছিলেন যে, চলে গেলেন শিলাইদহে, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। টমসন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর পোয়েট অ্যান্ড ড্রামাটিস্ট’-এ লিখছেন, ‘পরের দিন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম---তাঁর আমার সঙ্গে বাঁকুড়া যাবার কথা। কিন্তু তাঁর উৎসাহ ফুরিয়ে গেছে। মেজাজ থাকলে তাঁর উৎসাহ থাকে দানবের মতো, কিন্তু হঠাৎ সে উৎসাহ একেবারে হারিয়ে যায়…।’ তার পরে স্ত্রী থিওডোসিয়াকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘তিনি বাঁকুড়ায় কখনোই এলেন না, শেষ মুহূর্তে কথা দিয়ে কথা রাখলেন না…এটাই তাঁর অচেতন মনের অভ্যাস।’ রবীন্দ্রনাথ পরে অবশ্য বাঁকুড়ায় এসেছিলেন। কিন্তু টমসন তা দেখে যেতে পারেননি।

কলেজের সঙ্গে যুক্ত আর এক বর্ণময় পুরুষ রেভারেন্ড জন মিচেল। তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। কিন্তু নজর তাঁর শুধু আকাশেই ছিল না, ছিল মাটির কাছাকাছিও। ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ বছর দু’য়েক মিচেল ছিলেন বাঁকুড়া পুরসভার সভাপতি। তাঁরই আমলে ১৯১৬ সালে গন্ধেশ্বরী নদীতে পাম্প বসিয়ে শহরে পরিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়। কলেজের এই প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ ১৯১৭ সালে পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরে যান। কিন্তু থেকে গিয়েছিলেন বাঁকুড়ার অধিবাসীদের মনে।

তাঁর কাজকে মনে রেখে জনসাধারণের অর্থে কলেজে পাথরের ফলক বসে, আজও তা আছে। আর কলেজের একটি হস্টেলের নামই হয়েছে মিচেল হস্টেল। মিচেলের পরে অধ্যক্ষ ছিলেন রেভারেন্ড আর্থার ব্রাউন। ১৯১৭ থেকে ১৯৩৮, প্রায় একুশ বছর। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজের উন্নতিতে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁর নামেও একটি হস্টেল আজও চালু আছে কলেজে, ব্রাউন হস্টেল।

ইতিহাসের খোলা পাতার মতো কলেজের বিশাল প্রাঙ্গণে আজও ছড়িয়ে আছে নানা স্মৃতি-চিহ্ন। সে স্মৃতিতে ভালবাসা আর গর্বের সঙ্গে মিশে আছে কিছুটা অভিমানও।

লেখক উপ-পরিচালক, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ

Rabindranath Tagore Edward Thompson
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy