Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
আবার সেই নরম হিন্দুত্ব, আবার সেই ভুল-রাজনীতির চাল

ফাঁদে পা না দিলে চলত না?

রাজনৈতিক জয় হত বলছি এই জন্য যে রাজনৈতিক ক্ষতিটা কিন্তু রাহুলের হিন্দুত্ব-প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল। এক মুহূর্তও নষ্ট করেনি বিজেপি এর পর।

বরণ: কংগ্রেস সভাপতির পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করার পরে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে রাহুল গাঁধী। নয়াদিল্লি, ৪ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই

বরণ: কংগ্রেস সভাপতির পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করার পরে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে রাহুল গাঁধী। নয়াদিল্লি, ৪ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৩৭
Share: Save:

মা ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ঠাকুরদাদা পারসি। ঠাকুরমা হিন্দু বংশোদ্ভূত।— ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে ঠিক কী বোঝায় জানি না, কিন্তু এর থেকে বেশি ধর্মনিরপেক্ষ বংশপরিচয় আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। পারিবারিক উত্তরাধিকার যদি বহন করতেই হয়, তবে এই ‘ইউনিক’ পরিচয়টা বহন করাই যে কোনও ধর্মনিরপেক্ষ নেতার পক্ষে সবচেয়ে সম্মানজনক হত। কিন্তু রাহুল গাঁধী সে পথে হাঁটলেন না।

উল্টে পৈতে দেখিয়ে তিনি নিজের হিন্দুত্ব প্রমাণ করতে বসলেন! গত কয়েক মাসে তাঁর কাজেকর্মে বার বারই ধর্মনিরপেক্ষতা নামক আদর্শের অপলাপ হচ্ছে। তবে, এই পৈতে-কাণ্ডটির মধ্যে অপলাপের থেকেও একটা বড় কিছু আছে, একটা প্রতীকী পরাজয় আছে। তিনি বুঝতে পারলেন না যে, যা-ই বলুন বা করুন, তিনি যে একশো শতাংশ হিন্দু নন, এই ধুয়ো কিন্তু তোলা সহজ। আজকের দিনে এমন মিশ্র ধর্মপরিচয়ের উত্তরাধিকার গোটা পৃথিবীতেই দুর্লভ হয়ে আসছে: আর সেটাই রাহুলের সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা হতে পারত। অথচ সেখানেই তিনি হেরে গেলেন। পৈতের মধ্যে তো কেবল হিন্দুত্ব নেই, ব্রাহ্মণত্বও আছে। হিন্দুত্বের সবচেয়ে রক্ষণশীল জাতিভেদ প্রথার নির্দেশ আছে। তাই, হিন্দুত্বের নামে ব্রাহ্মণত্ব প্রমাণের ব্যস্ততা না দেখিয়ে রাহুল বরং তাঁর বহু ধর্মের বৃহৎ উত্তরাধিকার জোর গলায় বলতে পারতেন, তার উপর দাঁড়িয়ে হিন্দু সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাও বলতে পারতেন। সেটাতেই তাঁর জয় হত। নৈতিক জয়। রাজনৈতিক জয়ও।

রাজনৈতিক জয় হত বলছি এই জন্য যে রাজনৈতিক ক্ষতিটা কিন্তু রাহুলের হিন্দুত্ব-প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল। এক মুহূর্তও নষ্ট করেনি বিজেপি এর পর। অর্থমন্ত্রী জেটলি উকিলি তীক্ষ্ণতায় মন্তব্য করলেন, কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে কে হিন্দুত্বের আদত অভিভাবক, সকলেই জানে। বিজেপি যদি সামনে থাকে, মানুষ তবে বিজেপি-র ‘ক্লোন’-হতে-চাওয়া কংগ্রেসকে চাইবে কেন? আগমার্কা হিন্দুত্ব হাতের কাছে থাকলে টেনেটুনে-প্রমাণ-করা হিন্দুত্ব লোকে নেবে কেন?

বাস্তবিক, গুজরাত প্রচারপর্ব জুড়ে নানা ভাবে নরম হিন্দুত্বের আঁচ পুইয়েছেন রাহুল। অনুমান করা চলে, এটাই এখন কংগ্রেসের অবস্থান। বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে একটা ‘প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বে’ অবতীর্ণ হয়েছে কংগ্রেস। তাই, বিজেপি যে ভাষায় কথা বলছে, রাহুলও সেই ভাষা বলতে ব্যস্ত হয়েছেন। ওদের গেরুয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে উনিও কপালজোড়া লাল তিলক ও গাঁদা ফুলের ঐশী মালায় ছবি তুলছেন। ওদের মন্দির-যোগী-গুরু, তাই উনিও মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সোমনাথ মন্দিরের রেজিস্টারে নিজের নাম উনি সত্যি তুলেছিলেন, না কি পুরো ব্যাপারটাই বিজেপির ভণ্ডামি, সেটা প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু সোমনাথের দরবারে গিয়ে রাহুল গাঁধী যে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, সেটা তো ঠিক। শুধু গুজরাতে কেন, কয়েক মাস আগে বাৎসরিক ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসার পর থেকেই রাহুলের নরম হিন্দুত্ব লাইন পরিষ্কার। ফিরে এসেই গিয়েছিলেন কেদারনাথ দর্শনে। তার পর বৃন্দাবনে বঙ্কুবিহারী মন্দিরে। শাঁখ-ঘণ্টা বাজিয়ে পুরোহিতরা তাঁর হাতে দিলেন কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র, ‘মন্দ দশা’ কাটিয়ে ওঠার জন্য আশীর্বাদী উপহার। তা, মন্দ দশা কেটেছে রাহুলের, দলের সভাপতিত্বে আসন্ন অভিষেকের দিন হিসেবে বাছা হয়েছে সোমবার, অর্থাৎ ‘শিবের বার’!

এ বারের গুজরাত প্রচারে সংখ্যালঘুকেও যেন একটু দূরে সরিয়ে রাখলেন! গুজরাতে ভোটারদের নয় শতাংশ মুসলিম। অথচ রাহুলের প্রচারে সংখ্যালঘু সংযোগ ঘটল কম। এমনিতে কংগ্রেসে এ বার ছয় জন মুসলিম প্রার্থী, বিজেপিতে এক জনও নেই। কিন্তু ভারুচের মতো মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে কিংবা অমদাবাদ বা সুরাতের মতো মিশ্র জনবসতির মুসলিম মহল্লাগুলিতে কংগ্রেসের যাতায়াত ও প্রচার বেশি হল না। সম্ভবত তার পাল্টা নিতেই নরেন্দ্র মোদী প্রচারের শেষ পর্বে আলাদা করে মন দিলেন সংখ্যালঘুদের প্রতি।— রাহুল গাঁধী যদি মনে করেন, ২০১৯ সালের ভোটলড়াইয়েও এমন ‘নার্ভাস অ্যাপ্রোচ’ দিয়ে সংখ্যালঘুদের সামলাবেন, দেশের পক্ষে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে। ‘মি-টু’ পদ্ধতিতে রাজনীতি করে জেতা তো যায়ই না, গ্রহণযোগ্যতাও ধরে রাখা যায় না। বিজেপির দেখাদেখি কংগ্রেসও যদি একই কাজ করে, লোকে বিজেপিকেই নম্বর দেবে, কংগ্রেসকে নয়।

ওঁর বাপ-ঠাকুমাও এই ভুল করেছেন। ‘মি-টু’র থেকে তখন অবশ্য বেশি ছিল রক্ষণশীল হিন্দুদের না চটানোর তাড়া। তারা চটলে যদি হিন্দু ভোট কংগ্রেস থেকে ধসে যায়, এই ভয়ে ইন্দিরা-রাজীবসহ সমস্ত কংগ্রেস নেতারা বার বার হিন্দুত্ববাদীদের তোষণের চেষ্টা করেছেন। রামমন্দিরের তালা খুলে। শাহ বানো মামলায় পিছিয়ে এসে। মনে করা যেতে পারে, বাবরি মসজিদ চত্বরে ১৯৮৯ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে যখন প্রথম শিলান্যাস হল, অনুমতিটি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। ওই সিদ্ধান্ত তিনি নিশ্চয় নিয়েছিলেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দিকে চোখ রেখেই। যুক্তি দিয়েছিলেন, রামজন্মভূমিতে মন্দির করার অর্থ তো বাবরি মসজিদের ক্ষতি করা নয়! এই কমপ্রোমাইজ শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে গেল ঘটনাটাকে, সেটা মারাত্মক লজ্জা ও ভয়ের ইতিহাস। রাজীব গাঁধী তখন ছিলেন না। থাকলে কি ফিরে ভাবতেন যে, রক্ষণশীল জেদি হিন্দুত্বকে অতখানি আশকারা দেওয়াটা ঠিক হয়নি? কথাটা ভাবছি এই জন্য যে এই রাজীব গাঁধীই ১৯৮৫ সালে কংগ্রেসের শতবর্ষে মুম্বই-এর সভায় দ্ব্যর্থহীন স্পষ্টতায় বলেছিলেন, কংগ্রেসি নেতাদের সমস্যাই হল ছোট আর সংকীর্ণ স্বার্থ মেটাতে গিয়ে তাঁরা সমানে ‘স্লোগানস অব কাস্ট অ্যান্ড রিলিজিয়ন’-কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেন। চার বছর পর সেই রাজীবই কিন্তু ‘আত্মরক্ষা’ করতে পারেননি, একই ভুলে নিজেও ডুবেছেন। আজ আবার রাহুল গাঁধীও সেই একই দলীয় ও পারিবারিক ভ্রান্তির ঐতিহ্য মেনে চলছেন। গুজরাত প্রচারপর্বে তাঁর এলেম দেখা গেল, মোদীকে নিজের রাজ্যে বেকায়দা করতে পারার এলেম। কিন্তু এই প্রচারপর্বই বুঝিয়ে দিল, নরম হিন্দুত্বের বিপদ এড়িয়ে চলার দূরদৃষ্টি বা অন্তর্দৃষ্টি, কোনওটাই তাঁর নেই।

একটা কথা এঁরা বোঝেননি, বোঝেন না। ‘সবাই’কে নিয়ে চলতে হবে ঠিকই, কিন্তু ‘সবাই’-এর চাপে মূল আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা করলে নিজের পায়ের তলার মাটিটাই ঝুরঝুরে হয়ে যায়। ঠিকই, যা দিনকাল, আইডেন্টিটি পলিটিকস-এর যে বাড়বাড়ন্ত, তাতে জাত-স্বার্থ বা গোষ্ঠী-স্বার্থের ভাষায় কথা না বলে নেতাদের উপায় নেই। তেমনি ভাবেই, ধর্মীয় স্বার্থের দিকেও মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলে হয়তো চলে না। কিন্তু হিন্দু স্বার্থ দেখার অর্থ কি হিন্দু রক্ষণশীলতাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা? ধর্মসমাজের মধ্যেও তো অনেক স্তর, অনেক ভাগ থাকে। ধর্মের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, আর ধর্মের পশ্চাৎপদ রক্ষণশীলতা— এ দুটো কি পুরো এক জিনিস? প্রথমটা মানুষকে এক করে, কাছে টানে, আশ্রয় দেয়। আর অন্যটা মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটায়, সমাজকে তিক্ত ভাগাভাগিতে নিক্ষিপ্ত করে।

‘রামমন্দির’-এর মতো, পৈতের মধ্যেও হিন্দুধর্মের কোনও মাহাত্ম্য বা একত্ব নেই, ওগুলো কেবল সামাজিক বিভাজনের সূত্র। রাহুল গাঁধী, কংগ্রেসের ভাবী সভাপতি, অভিষেকের আগেই ধর্মের নামে সেই ভয়ানক ফাঁদে পা দিয়ে ফেললেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Gandhi Congress BJP Hinduism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE