Advertisement
E-Paper

ছাপ্পান্ন ভোগ ছাপ্পান্ন রোগ

বা  বা বা! তোরা গরমের ছুটিতে দার্জিলিং দাবড়াবি, পুজোর ছুটিতে পাটায়া পালাবি, আর আমি একটা ছুটি নিলে গোটা ভারত মিলে আমার টুঁটি টিপে ধরবি? আমি একটা দামড়া ছেলে, বেড়াতে গিয়ে স্পা-তে পা টেপাচ্ছিলাম, না সুইমিং পুলে পিরানহা ছাড়ছিলাম, না মন্দিরে জেন-ধ্যান প্র্যাকটিস করছিলাম, তোকে ফিরিস্তি দেব? লোকে ভাবে, একটা বিখ্যাত পরিবারে জন্মাবার কী অলৌকিক সুবিধে!

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৪৩

বা  বা বা! তোরা গরমের ছুটিতে দার্জিলিং দাবড়াবি, পুজোর ছুটিতে পাটায়া পালাবি, আর আমি একটা ছুটি নিলে গোটা ভারত মিলে আমার টুঁটি টিপে ধরবি? আমি একটা দামড়া ছেলে, বেড়াতে গিয়ে স্পা-তে পা টেপাচ্ছিলাম, না সুইমিং পুলে পিরানহা ছাড়ছিলাম, না মন্দিরে জেন-ধ্যান প্র্যাকটিস করছিলাম, তোকে ফিরিস্তি দেব? লোকে ভাবে, একটা বিখ্যাত পরিবারে জন্মাবার কী অলৌকিক সুবিধে! এ কথা ঠিকই, জন্মদিনের পার্টিতে দেশের প্রেসিডেন্ট এসে ল্যাবেঞ্চুস বাড়াচ্ছে, ভালই লাগে। তার পর একটু স্পিডে নিজ লেনে জগিং করতে গেলেই ইতিহাসের চ্যাপটার মুখে লেপটে যায় জায়ান্ট চামচিকের মতো। জোরে হাঁচতেও ভয় করে। পরিবারের প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে না তো? কেউ বন্ধুত্ব করলে মনে হয়, এ আমায় ভালবাসছে, না লোকের কাছে রং নেওয়ার মেটিরিয়াল জোগাড় করছে? বক্তৃতা দেওয়ার পর যে চেনা লোকগুলো ক্ল্যাপ লাগায়, দেখে মনে হয়, ব্যাটারা শিয়োর পার্টিতে বড় পোস্ট পাওয়ার জন্যে তেল মারছে। একটা প্রজাপতি উড়ে নাকে বসলেও ভাবি, নিশ্চিত স্পাইক্যাম। আর এ সব থেকে ঊধ্বর্শ্বাসে পালালে? মিডিয়া রগড়ের বন্যা বইয়ে দেয়।

সাধারণ লোক হয়ে জন্মাবার কী অবিশ্বাস্য আমোদ! কেউ তোমার কাছে কিস্যুটি প্রত্যাশা করে না, এমনকী ঠিকঠাক চাপড়ে মশা মারতে পারবে বলেও কেউ বিশ্বাস করে না। কাজ বলতে সকালে উঠে কাগজ পড়ে সমস্ত বড় বড় লোকের নিন্দে, সন্ধেবেলা টিভি খুলে সমস্ত বড় বড় লোকের নিন্দে। আমার ফ্যান্টাসি ছিল, পাবলিক হব। তার পর ঝাঁকুনিও খেলাম। এক বার স্টান্ট দেওয়ার জন্যে, ফটাস করে লোকাল ট্রেনে উঠে পড়লাম। কথা ছিল, হেলিকপ্টার চড়ব। শিব সেনা এয়ারপোর্টের রাস্তায় কালো ফ্ল্যাগ-ট্যাগ নিয়ে তৈরি। আর আমি কিনা এটিএম থেকে টাকা তুলে, টিকিট কেটে, স্ট্রেট ট্রেনে! স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ফাট্টাফাট্টি। সবাই বলল, আমি সাধারণ মানুষের মেজভাই। কিন্তু বাস রে, কী যাচ্ছেতাই ব্যাপার! লোকে এই ভাবে দিনের পর দিন অফিস যায়, জীবন কাটায়! তখন বুঝলাম, সাধারণ হওয়ারও বহুত চাপ। অন্তত সারা জীবন রুপোর চামচে মুখে জাগ‌ল করে এবং একশোটা চামচে চার পাশে হ্যান্ডল করে যে বড় হয়েছে, সে আর যা-ই হোক, সাধারণতা উদযাপন করতে পারবে না। অবশ্য মাঝে মাঝে ঝোঁকটা চেপে বসে। ওডিশার একটা গ্রামে চার ঘণ্টা আদিবাসীদের সঙ্গে কাটালাম, কুঁড়েয় বসে ওদের সঙ্গে খেলামও। চাষিদের সঙ্গে টানা ১৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আন্দোলনও করেছি। ওই সময়টায় একটা দুরন্ত কিক-ও পাই, সত্যি। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে মনে হয়, বাপ‌স্! এসি-টা বাড়িয়ে দে ভাই।

আমাকে নিয়ে নাটক হতে পারে, বা ভাল আর্ট ফিলিম। পড়াশোনা অবধি ছদ্মনামে করেছি। সারা ক্ষণ ভয়ে থেকেছি, আমাকেও উড়িয়ে দেওয়া হল। ঠাম্মা ওই ভাবে মারা গেল। বাবার তো জুতোটুকু শুধু অক্ষত ছিল। বাবার সৎকারের সময় টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট হল, সারা ভারতের যত যুবক ছিল, দিদির প্রেমে পড়ে গেল। কী ট্রমা নিয়ে চলতে হয় একটা মানুষকে! তার পর সারা ক্ষণ শুনি, দিদি আমার চেয়ে অনেক ভাল লিডার হবে। কেন? না, ওর মুখের সঙ্গে ঠাম্মার মুখের খুব মিল। বোঝো, শুধু খাড়া নাক আর গোঁঁয়ার থুতনি দেখেই লোকে খ্যামতা বুঝে গেল! রবীন্দ্রনাথের তো দাড়ির চোটে মুখটাই ভাল করে দেখা যেত না রে! কী করে ক্যালি বুঝতিস? এই যে ছুটি কাটিয়ে এলাম, এমন ভাগ্য, হবি তো হ, ঠিক ৫৬ দিন। কেউ মুখ ভেটকে বলছে ‘অব তক ছপ্পন’, কেউ বলছে মোদীর ৫৬ ইঞ্চির জবাবে কিনা ৫৬ দিন অকর্মণ্যতা! ট্রাভেল এজেন্টটাকে ধরে চোখ গেলে দিতে ইচ্ছে করছে! ৫৫ বা ৫৭ করতে পারলি না?

আসলে আমার জন্মের পর থেকেই সবাই অপেক্ষা করছিল, আমি একটা বিরাট কিছু করব, একটা বোম ফাটাব। সত্যি বলব? আমিও অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু বিস্ময়-বালক জন্মায়, অজিত আগরকর যেমন, যে চিরকালই বিস্ময়-বালক থেকে যায়। মানে, বয়সটা বেড়ে যায়, এবং সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে, সে বালকোচিতই থেকে গেল। কখনও আর সেই ঝিংচ্যাক ক্লাইম্যাক্সটা এসে পৌঁছল না। আমি এক-এক বার ভাবি, তেড়েফুঁড়ে উঠি, ক্যান্টার করে দিই। এই তো এক বার ক্যাম্পেনের সময় ছ’হপ্তায় ১২৫টা বক্তৃতা দিলাম। যুব কংগ্রেসটাকে একেবারে পালটে নতুন প্রাণের ফ্লাড বইয়ে দেব, ঘোষণা করলাম। এক বার একটা অর্ডিন্যান্স নিয়ে এমন রাগ হল, প্রেস কনফারেন্সে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে বললাম, এটা একদম ননসেন্স, এটাকে ছিঁড়ে ফেলে, ছুড়ে ফেলে দেওয়া উচিত! কংগ্রেসের লোক হয়ে মনমোহন সিংহের বিরুদ্ধে এমন রাগি মুখফোঁড় কমেন্ট! ঢি-ঢি পড়ে গেল। কিন্তু বিপ্লবের ওই ইয়েটা, আমাশার পেটব্যথার মতোই, ফস করে মিলিয়ে গেল। কখন আসে, কখন যায়, ভাল বুঝতে পারি না।

আসল প্রেয়ারটা বলি? আমায় ছেড়ে দে ভাই। আমার বংশে সবাই হিস্ট্রির পাতায় ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া দাগ রেখে গেছে, ভাল কথা। তাই বলে আমার কেন কিচ্ছু না-করার অধিকারটা থাকবে না? আমি তো গরিব নই, যে, রোজগার করতে হবে। ব্যর্থ বাপ-মা’র সন্তানও নই, যে, আমার মধ্যে দিয়ে তারা নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করার দৌড় শানাচ্ছে। তা হলে আমার কীসের চাপ? অপদার্থতার শান্তিটা আমায় উপভোগ করতে দে না রে হতভাগা! অবশ্য কেউ বলতে পারে, আপনিই বা ছেড়েছুড়ে দিচ্ছেন না কেন সবটা? ওই তো মুশকিল! এক বার ভাবি, বিদেশ গিয়ে বিয়ে-থা করে হাই তুলতে তুলতে সচ্ছল ফুর্তিময় জীবন কাটাই, এক বার মনে হয়, উঁহু, পাকা চুলে একটা নোবেল পিস প্রাইজ নিয়ে কেরিয়ার শেষ করতে হবে। লোকে দোটানায় ভোগে, আমার ছাপ্পান্ন-টানা!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

Congress Rahul Gandhi sabbatical leave general people politics tour
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy