Advertisement
E-Paper

স্বপ্ন গড়ার কারিগর: রামকিঙ্কর বেজ

রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর তিনি। শিক্ষক নন্দলাল বসু বলেছিলেন, স্বপ্ন আঁকতে। রাতের স্বপ্নগুলো না ভুলতে। স্বপ্নের মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে তা লিখে রাখতে। স্বপ্নেই ছবি আসে, প্রতিমা আসে। শান্তিনিকেতনের স্বপ্ন গড়ার কারিগরকে নিয়ে লিখলেন মাধব ভট্টাচার্য।রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর তিনি। শিক্ষক নন্দলাল বসু বলেছিলেন, স্বপ্ন আঁকতে। রাতের স্বপ্নগুলো না ভুলতে।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:২১
রামকিঙ্কর বেজ। —ফাইল চিত্র।

রামকিঙ্কর বেজ। —ফাইল চিত্র।

আকণ্ঠ সুরাপানে ছিল তাঁর অফুরান আনন্দ। সেই আনন্দে তিনি মগ্ন হতেন তাঁর শিল্পকর্মে। মানুষটার ভেতরে অন্য যে মানুষটার বাস, সেই মানুষটাই তখন তাঁকে নিয়ে যেত এক কল্পলোকে — যেখানে তাঁর শিল্পীসত্তা তাঁর হাত দিয়ে গড়িয়ে নিত নানান শিল্পকলা। কখনও সিমেন্ট-বালি-পাথরকুচি ছিল তার উপাদান, কখনও বা ক্যানভাসে রং-তুলির আঁচড়। জীবনভর অসংখ্য শিল্পসম্ভারে গড়ে তুলেছেন তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডার। এমনকি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়েও চলেছে তাঁর ছবি আঁকা, দুর্গার প্রতিরূপ। এ শিল্পীই হলেন রামকিঙ্কর বেজ। যিনি দারিদ্র্য সম্বল করে জন্মেছিলেন বাঁকুড়ার অখ্যাত যুগীপাড়া গ্রামের ক্ষৌরকার পিতা চণ্ডীচরণের ঘরে — আর সম্মানের মুকুট মাথায় পরে ৭৪ বছরের জীবন কাটিয়ে পাড়ি দিয়েছেন এক অমর্ত্যলোকে! তার পর তিন-তিনটে যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। তবু আজও তিনি প্রাসঙ্গিক।

জন্ম যদিও বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে, কিন্তু জীবন কেটেছে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে। সেটা সম্ভব হয়েছিল যশস্বী সম্পাদক-সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। কার মূর্তি গড়ছেন জানতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। রামকিঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি নে। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’’

পরাধীন দেশে স্বদেশী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ ও আত্মদানের ঘটনা বালক রামকিঙ্করের অন্তরাত্মাকে রক্তাক্ত করেছে বারবার। শিল্পীর কাছে যদিও সংগ্রামের মাধ্যম ছিল রং-তুলি। তাই দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন সংগ্রামের নানা বিষয়, আন্দোলনের অভিব্যক্তি। পোর্ট্রেট করেছেন বহু বিপ্লবীর। আর এ সব দেখেই বোধহয় নজর পড়েছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের। পাকা জহুরির চিনে নিতে ভুল হয়নি নবীন প্রতিভাকে। তাই রামানন্দ একদিন যুগীপাড়া থেকে রামকিঙ্করকে এনে হাজির করলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে!

রামকিঙ্করের বয়স তখন ১৯। সালটা ১৯২৫। শান্তিনিকেতনে এসে রামকিঙ্কর ভর্তি হলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনে। সেই থেকে আমৃত্যু (২ অগস্ট, ১৯৮০) দীর্ঘ ৫৫ বছর রামকিঙ্করের বসবাস শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের অদ্বিতীয় পরিবেশ রামকিঙ্করকে শুধু একজন বিশিষ্ট ভাস্করই নয়—চিত্রকর, নাট্যকার ও গায়ক হতেও সাহায্য করেছিল।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে সব সময় উৎসাহিত করেছেন শিল্পীর স্বাধীনতা উপভোগে। তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নানা ভাবে সাহায্যও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলতেন, শান্তিনিকেতন আশ্রমের সর্বত্র যেন তাঁর দৃষ্টির ছোঁয়ার প্রতিফলন ঘটে তাঁর শিল্পকর্মে। মূর্তিতে মূর্তিতে ভরে দিতে বলেছিলেন আশ্রম প্রাঙ্গণ। রামকিঙ্কর তা করেওছিলেন। তাঁর হাতে গড়া গৌতম বুদ্ধ, সাঁওতাল পরিবার, মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ, সুজাতা... এ রকম অজস্র শিল্পকর্ম ছড়িয়ে রয়েছে শান্তিনিকেতন জুড়ে! শিক্ষাগুরু নন্দলাল বসুও শিল্পসাধনায় নিজস্ব ভাবনাকেই প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন রামকিঙ্করকে।

রামকিঙ্করের শিল্পকর্মের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে আদিবাসী জীবন। তাঁর বিখ্যাত সাঁওতাল পরিবারের মূর্তিতে তিনি দেখিয়েছেন, এক সাঁওতাল যুবক তার সঙ্গিনীকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে ঘরমুখো। বউয়ের কোমরে একটি বাচ্চা অন্য একটি বাঁকেতে। একটি কুকুরও হেঁটে চলেছে ওদের সঙ্গে। এ ছাড়া রয়েছে সংসারের অতি সামান্য কিছু উপকরণ। অত সামান্য প্রাপ্তিতেই যেন আনন্দ উপচে পড়ছে তাদের—চলার মধ্যে কী এক দৃপ্ত ভঙ্গিমা আর ঘরে ফেরার সুখানুভূতি!

আদিবাসী সমাজের বিয়ে, মহিলার ধান মাড়াইয়ের দৃশ্যপট — গ্রামজীবনের এমন ছবিই তাঁকে টানত বেশি। তাঁর ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া সবই ছিল প্রাণের আনন্দে। কারও ইচ্ছাপূরণের তাগিদে নয়।

ছাত্র থেকে শিক্ষক, শিক্ষক থেকে কলাভবনের অধ্যক্ষ। মূর্তি গড়েছেন, ছবি এঁকেছেন অসংখ্য। নুড়িপাথর আর সিমেন্ট-বালির মিশেল দিয়ে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সব মূর্তি। দারিদ্র্যের মধ্যেও হাসি ছিল, প্রাণখোলা হাসিতে সবার প্রাণ ভরিয়ে দিতেন। উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান, লালন ফকিরের গান—

‘ও আমার চাঁদের আলো,

আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে

ধরা দিয়েছ যে আমার

পাতায় পাতায় ডালে ডালে’।

আর একটি—

‘আজ তারায় তারায়

দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে

নিদ্রাবিহীন গগনতলে’।

এই রবীন্দ্রসঙ্গীত দুটি গাইতে ভালবাসতেন তিনি।

রামকিঙ্করের এক প্রিয় ছাত্র, শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রত্যেক বুধবার তাঁর সঙ্গে আমরা আশেপাশের গ্রামে চলে যেতাম কাজ করতে। সঙ্গে সারা দিনের খাবার, রং-তুলি-কাগজ। নিজে বসে দেখাতেন, প্রকৃতিকে কেমন ভাবে নিজের মতো করে ধরতে হয়। কেবলই হুবহু নয়—নিজের ভাবনা অনুভবেরও কেমন ভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে হয়।’’

রামানন্দদা বলতেন, ‘‘কিঙ্করদাকে কোনও দিন বেঁকে বসতে দেখিনি। শিরদাঁড়া টানটান করে সোজা হয়ে বসতেন। ছবি আঁকায়, মূর্তি গড়ায়, গান গাওয়ায় যে বলিষ্ঠতা, যে তীক্ষ্ণতা, যে শৌর্য কাজ করত, নিজের চলাফেরা, কথা বলা বা হাঁটাচলার প্রতিটি ভঙ্গিতে সেই লাবণ্য, সেই সৌন্দর্যই স্পষ্ট হয়ে ঝরে পড়ত।’’

অনেক না পাওয়ার মধ্যেও মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। মৃত্যুর ১০ বছর আগে ভারত সরকার শিল্পী রামকিঙ্কর বেজকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৭৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। ১৯৭৬-এ অকাদেমির ফেলো হন। বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ দেয় ১৯৭৭ সালে। এর পর ১৯৭৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট। ১৯৭৫ সালে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক রামকিঙ্করকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

ব্যক্তিজীবন ছিল খুব অগোছালো, বন্ধনহীন। প্রেম ছিল হৃদয় পূর্ণ করে। কিন্তু তা উজা়ড় করে দেওয়ার মতো প্রাণস্পর্শীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কি না, কে জানে! জীবনভর যে রাধারানি ছিলেন তাঁর পাশে, জীবনের সর্বস্ব যিনি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন শিল্পীকে— তিনিই বা ঠিক কতটুকু পেয়েছিলেন, এ প্রশ্নও থেকেই যায়। যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, কেন যেন তাঁরাও কখনও বুঝতে পারেননি, ‘রামকিঙ্কর’ নামের রক্তে-মাংসে গড়া এই শিল্পী মানুষটির মনের গভীরে দুঃখের নিশ্চুপ কোনও আসন পাতা ছিল কি না!

(লেখক লোক সাহিত্য ও আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক)

Ramkinkar Baij রামকিঙ্কর বেজ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy