প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হইলে বিচারের বাণী কাঁদিয়া ফেরে। কিন্তু যদি বিচারের দাবিতে কেহ রুখিয়া দাঁড়ায়? দিল্লিতে গণধর্ষিতা এক কিশোরী এক আশ্চর্য পরিস্থিতি নির্মাণ করিয়াছে। পুলিশের নিকট তাহার অভিযোগ, মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার জন্য উৎকোচ লইয়াছে তাহার পিতামাতা। প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা মেয়েটি থানায় জমা দিয়াছে। অতঃপর তাহার মা গ্রেফতার হইয়াছে, বাবা পলাতক। এমন সম্ভাবনার কথা বিপর্যস্ত মেয়েটি ভাবিয়াছিল কি না, তাহার দুই অভিভাবকের অনুপস্থিতি তাহাকে আরও অসহায় করিল কি না, কে বলিতে পারে। কিন্তু ন্যায় পাইবার দাবিতে অবিচলিত থাকিয়া ওই কিশোরী এ দেশের তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার ফাঁকটিকে উন্মুক্ত করিল। ন্যায়ের সম্মুখে ধনী ও দরিদ্র সমান, এই সত্যটি এ দেশে আজ যেন উপহাসে পরিণত হইয়াছে। এই নীতি কত ভাবে বিপর্যস্ত হইতে পারে, তাহার বিচিত্র দৃষ্টান্ত দেশবাসী দেখিতেছে। কখনও আদালতে বিচারপ্রক্রিয়ায় বিশ বৎসর অতিক্রান্ত হইতেছে, কখনও সাক্ষীরা নিরুদ্দেশ, দুর্ঘটনায় নিহত অথবা রহস্যময় পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করিতেছে। সাক্ষীদের প্রভাবিত করিয়া, ঘুষ দিয়া বা ভয় দেখাইয়া সাক্ষ্য বদলের অভিযোগেরও অভাব নাই। সাক্ষী প্রতিকূল হইবার ফলে অজস্র গুরুতর অপরাধের মীমাংসা হয় নাই।
পুলিশকে প্রভাবিত করিয়া তদন্তকে প্রহসনে পরিণত করিবার অভিযোগও বহুশ্রুত। সম্প্রতি হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের সকলেই ‘প্রমাণাভাবে’ মুক্তি পাইল। বিস্ফোরণের জন্য দায়ী কে, কাহার অপরাধে এতগুলি মানুষ প্রাণ হারাইল, তাহার সমাধান হইল না। এই হতাশার তিক্ততা অত্যন্ত পরিচিত। রাজনৈতিক নেতা, চলচ্চিত্র তারকা এবং ধনী শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ইহাই প্রত্যাশিত পরিণতি। ইহার অপর পিঠ দরিদ্র মানুষ, প্রত্যন্ত এলাকার দলিত-আদিবাসীকে যে কোনও অভিযোগে আটকাইয়া রাখিবার সহজসাধ্যতা। কাশ্মীরের বালিকার ধর্ষণের ঘটনা ও তাহার পরবর্তী ‘প্রতিবাদ’ প্রমাণ করিল, বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করিবার জন্য তৎপর হইতে আজ আর প্রভাবশালীর লজ্জা নাই। ষাট-সত্তরের দশকে মুম্বইয়ের হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রকাশ্যে কুকীর্তির আস্ফালনের কাজটি খলনায়কের জন্য বরাদ্দ ছিল। নায়কের ভাগে পড়িত ঈশ্বরভক্তি ও দেশপ্রেম। আজ সেই সকলই আসিয়াছে এক পক্ষে। কিন্তু পরিসংখ্যান সত্যবাদী। নারী নির্যাতনে শাস্তির হার কমিতেছে। সত্তরের দশকে ধর্ষণে অভিযুক্ত শাস্তি পাইত চুয়াল্লিশ শতাংশ ক্ষেত্রে, আজ শাস্তি হয় পঁচিশ শতাংশের।
দিল্লির কিশোরীর ব্যতিক্রমী অবস্থান আরও একটি বিষয়কে সম্মুখে আনিয়াছে। তাহা এই যে, পরিবার একটি মেয়েকে নিজস্ব সম্পত্তি বলিয়া মনে করে। পিতা-ভ্রাতা বা স্বামী-শ্বশুর তাহার যৌনতা, এমনকী জীবনকেও পণ্য ধরিয়া তাহার অঙ্ক নির্ধারণ করিতে পারে। এই কারণেই ধর্ষণ কিংবা বধূহত্যার পরে ‘ক্ষতিপূরণ’-এর অঙ্ক লইয়া দরদস্তুর প্রায় নিয়মিত হইয়া থাকে। কন্যাটি আবিষ্কার করে, পিতা ও ধর্ষক দুই-ই এক পক্ষে। সে একা দাঁড়াইয়া বিপরীতে। ইহাই পুরুষতন্ত্রের স্বরূপ। পিতার উৎকোচগ্রহণের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করিয়া দিল্লির কিশোরী তাহারই প্রতিবাদ করিয়াছে। তাহার রাষ্ট্র তাহাকে সমর্থন করিবে কি না, এ বার সেই সিদ্ধান্ত লইতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy