Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Indian Economy

প্রকৃত লজ্জা

তাহা হইলে ভারতের কি লজ্জার কোনও কারণ নাই? আছে, কিন্তু অন্যত্র। জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান কিছু শুষ্ক সংখ্যামাত্র— সেই আয় জনজীবনকে কী ভাবে উন্নততর করিয়া তুলিতে পারে, তাহাই মূল বিবেচ্য।

প্রতীকী ছবি।  

প্রতীকী ছবি।  

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২০ ০১:৫৩
Share: Save:

মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে এই বৎসর ভারতকে টপকাইয়া যাইবে বাংলাদেশ, এই সংবাদে কাহারও জাতীয়তাবাদী আবেগে আঘাত লাগিলে আশ্বস্ত করা যাইতে পারে, খুব সম্ভবত পরের বৎসরই ভারত ফের আগাইয়া যাইবে। এই আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যদ্বাণীটির মধ্যে অবশ্য একটি পূর্বানুমান আছে— ভারতীয় অর্থনীতির কর্তারা সেই একটি বৎসর সামলাইয়া থাকিবেন, ডিমনিটাইজ়েশন গোত্রের কোনও আত্মঘাতী পথে হাঁটিবেন না; অথবা, অর্থব্যবস্থা পরিচালনায় এত দিন তাঁহারা যতখানি অপারদর্শিতার প্রমাণ দিয়াছেন, তাহার অধিক অপারদর্শী হইয়া উঠিবেন না। পূর্বানুমানগুলি কতখানি সঙ্গত, সেই প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাকুক। এই কথাটিও স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয় যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আয়বৃদ্ধির পশ্চাতে একটিমাত্র ক্ষেত্রের ভূমিকা প্রবল— তাহার নাম বস্ত্র উৎপাদন। এই একটি শিল্পে বাংলাদেশ সত্যই আন্তর্জাতিক উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হইয়া উঠিতে পারিয়াছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ ইত্যাদি হুঙ্কারও ভারতকে উৎপাদনের কোনও একটি ক্ষেত্রে এমন মহাশক্তি করিয়া তুলিতে পারে নাই, এই অনস্বীকার্য সত্যটিকে মাথায় রাখিয়াও বলিতে হয়, একটিমাত্র ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল আর্থিক বৃদ্ধি বিপজ্জনক। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অঙ্কে, এক বৎসরের জন্য হইলেও, ভারতকে টপকাইয়া যাইবার সম্ভাবনা তৈরি করা বাংলাদেশের একটি বিশেষ কৃতিত্ব, তাহা সংশয়াতীত, কিন্তু ইহাই শেষ কথা নহে।

তাহা হইলে ভারতের কি লজ্জার কোনও কারণ নাই? আছে, কিন্তু অন্যত্র। জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান কিছু শুষ্ক সংখ্যামাত্র— সেই আয় জনজীবনকে কী ভাবে উন্নততর করিয়া তুলিতে পারে, তাহাই মূল বিবেচ্য। মানবোন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারত বাংলাদেশের নিকট পাঁচ গোল খাইতেছে, ইহাই প্রকৃত লজ্জার কারণ। এবং, সেই ঘটনাটি এই বৎসর ঘটে নাই, এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ মানবোন্নয়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ ভারতকে পিছনে ফেলিয়া দিয়াছে। অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ তাঁহাদের ইন্ডিয়া: অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি গ্রন্থে দেখাইয়াছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মানবোন্নয়নের প্রশ্নে ভারত সমানেই পিছাইয়া পড়িতেছে। বস্তুত, কিছু সূচকে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণবর্তী আফ্রিকা ব্যতীত গোটা দুনিয়াই ভারতের তুলনায় ভাল অবস্থানে আছে। লজ্জা এখানে। যে দেশ মাত্র কয়েক মাস পূর্বেও জাতীয় আয়ের হিসাবে আন্তর্জাতিক মহাশক্তি হিসাবে গণ্য হইবার দাবি পেশ করিত, সেই দেশ তাহার আর্থিক বৃদ্ধির সুফল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নিকট পৌঁছাইয়া দিতে ব্যর্থ, ভারতীয় নেতারা এই বাস্তবটিতে তিলমাত্র লজ্জিত হন না, তাহা আরও বড় লজ্জার কথা।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, লিঙ্গসাম্য, পুষ্টি— মানবোন্নয়নের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিকেরই বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় আগাইয়া আছে। অকারণে নহে। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যেমন প্রতি তিনটি গ্রামে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন ও সেইগুলির যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণ নাগরিকদের জীবনের গুণগত মানবৃদ্ধিতে সহায়ক হইয়াছে। গ্রামীণ শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করিতে অসরকারি সংস্থার সহিত যৌথ উদ্যোগে ‘পুষ্টি আপা’ প্রকল্প চালু হইয়াছে, এবং তাহা যথার্থই কাজ করিতেছে। মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ফের ভারতের তুলনায় পিছাইয়া পড়িলেও এই বৈশিষ্ট্যগুলি হারাইয়া যাইবে না। যাঁহারা ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের তত্ত্ব খাড়া করিয়া তাহাকে বিষাক্ত রাজনীতির আয়ুধ বানাইতে চাহেন, বহু কোটি টাকা ব্যয়ে নাগরিকপঞ্জি নির্মাণ করিতে চাহেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বিতাড়নের উদ্দেশ্যে, তাঁহারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন— উন্নততর জীবনের সম্ভাবনা ছাড়িয়া বৈষম্য ও দারিদ্রের কুম্ভীপাকে প্রবেশ করিতে চাহিবে কে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economy GDP Job Indian Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE