Advertisement
E-Paper

ঝোলাওয়ালার অর্থনীতি

বেশির ভাগ লোক জানেনই না গুজরাত মডেল বস্তুটি আসলে কী। যাঁরা জানেন বলে ভাবেন, তাঁদের মধ্যেও মতানৈক্য আছে। কাজেই, কোন মডেলের দৌলতে জয়, এটা নিছকই অনুমানের প্রশ্ন।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৮ ০১:১৪

ঝোলাওয়ালা’ শব্দটা যে গালি, তা বুঝতে হলে দিল্লি পৌঁছতে হবে। দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আর, সে রাজধানীতে ‘ঝোলাওয়ালা’ হলেন তাঁরা, যাঁদের ঝুলির ভিতর থেকে সাধারণ মানুষের— কর্মসংস্থান যোজনার টাকা ঠিক সময়ে ব্যাঙ্কে না ঢুকলে যাঁদের ঘরে হাঁড়ি চ়়ড়ে না, সেই সাধারণ মানুষের— কথা বেরিয়ে আলোচনার টেবিলে ঠাঁই পেতে চায়।

অর্থনীতির শীলিত, শীতল যুক্তির পরিসর থেকে ঝোলাওয়ালাদের দূরে রাখতে না পারলে মুশকিল। ছাপ্পান্ন ইঞ্চির নেতা যখন বৃদ্ধির হারের খোয়াব ফিরি করেন, তখন যদি প্রশ্ন ওঠে যে রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার নম্বর জুড়তে না পারার অপরাধে এগারো বছরের একটা মেয়েকে না খেতে পেয়ে মরে যেতে হল কেন— তা হলেই জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের গল্পগাছা অলীক ঠেকতে থাকে।

ঝোলাওয়ালা অর্থনীতিবিদের তকমা নিয়ে অবশ্য জঁ দ্রেজ (ছবি) দিব্য আছেন। নিজের নতুন বইয়ের নামই রেখেছেন ‘ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি ও কাণ্ডজ্ঞান’ (আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৮)। অর্থনীতির প্রশ্নটাকে কী ভাবে দেখেন দ্রেজ, তার একটা মোক্ষম উদাহরণ বইয়ের ভূমিকায় রয়েছে। রাঁচিতে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে প্রতি দিন সকালে একটা মিছিল যায়— ‘‘শয়ে শয়ে যুবকের দল এক-একটা সাইকেলে দু’কুইন্টালেরও বেশি চোরাই কয়লার বস্তা চাপিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।’’ এই দৃশ্য অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দিতে পারে। দ্রেজ একটা নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন— কেন এঁদের এই দুরবস্থা, আর আমাদের অবস্থাটা অন্য রকম? তাঁর উত্তর: ‘‘বেশির ভাগই কিন্তু তাদের দুর্দশার জন্য তারা নিজেরা কোনও ভাবেই দায়ী নয়। নিচু জাতের দরিদ্র পরিবারে তাদের জন্ম, শৈশবে অপুষ্টির শিকার, লেখাপড়ার সুযোগ তারা পায়নি। যদি তারা ভিন্ন পরিবেশে জন্ম নিত, বড় হত, তা হলে তাদের মধ্যে কেউ হতে পারত ভূতত্ত্ববিদ, কেউবা ইঞ্জিনিয়র, শিল্পী অথবা হকি চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু তারা কখনওই তা হবার সুযোগ পায়নি।’’

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভারতের কাছে কী প্রত্যাশা করতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তরে ১৯৫৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘কারও যেন সুযোগের অভাব না-হয়, কারণ উন্নতির সুযোগের অভাবের চেয়ে খারাপ আর কিছু হয় না। ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েরা যে যে দিকে চায়, যেন উন্নতি করতে পারে, আমরা সেটুকু নিশ্চিত করব।’’ ৬৫ বছর পেরিয়ে ভারত কোথায় দাঁড়িয়েছে, রাঁচির রাস্তায় কয়লাওয়ালাদের মিছিল সেই উত্তর দেয়।

কেন সুযোগের অভাবে আটকে গেল কোটি কোটি মানুষের জীবন? যে অর্থনৈতিক চিন্তা এই সুযোগের সাম্য তৈরি করতে পারত, তার উপযোগী রাজনীতির অভাবেই কি নয়? জঁ দ্রেজকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যে অর্থনীতির কথা বলেন, যেখানে সম্পদের সম-পুনর্বণ্টনের ওপর জোর, তার সঙ্গে রাজনীতির সংলাপের পরিসরটি কেমন? দ্রেজ বললেন, ‘‘যে জিনিসগুলো সবার জন্য— যাকে কমন গুড বলে, তার দিকে নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থান থেকে করব্যবস্থা, পরিবেশনীতি, জমির অধিকার, গণপরিষেবার মতো জিনিসগুলো, যার সঙ্গে গরিব মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার দিকে গরিবের অবস্থান থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। যদি আরও একটু এগিয়ে ভাবি, কর্মক্ষেত্রে শোষণের অবসান হওয়া চাই, কাজে আরও বেশি অংশীদারি চাই। অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রয়োজন। এবং, অম্বেডকরের মতোই মনে করি, সামাজিক-রাজনৈতিক গণতন্ত্রের একটি স্বাভাবিক অঙ্গ হল অর্থনৈতিক গণতন্ত্র। এই পরিসরটাই রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সংলাপের।’’

সবার জন্য উন্নতির সমান সুযোগ তৈরি হয়নি। কিন্তু, হয়েছেও অনেক কিছু। দ্রেজ মনে করালেন তেমনই কিছু ‘হওয়া’র কথা। গত দু’দশকে মিড-ডে মিল থেকে আইসিডিএস, কর্মসংস্থান যোজনা— অনেক কিছুই তৈরি হয়েছে, যাতে পিছিয়ে পড়া মানুষের লাভ হয়েছে অনেকখানি। যে রাজনীতি অন্তত এটুকুও অর্জন করতে পারে, সেটা কেমন?

‘‘যে দেশের অর্থনীতি আড়েবহরে বাড়ছে, এবং যেখানে খানিক হলেও গণতন্ত্র আছে, সেখানে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ব্যয় যে বাড়বে, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ।’’ বললেন দ্রেজ। ‘‘গোটা দুনিয়াতেই এই ব্যয় বেড়েছে। শুধু ধনী দেশগুলোতে নয়, অনেক উন্নয়নশীল দেশই কল্যাণখাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। ভারতেও কেরল, তামিলনাড়ু বা হিমাচলপ্রদেশের মতো রাজ্যে দীর্ঘ দিন ধরে সরকার কল্যাণ খাতে জোর দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে প্রথম ইউপিএ-র আমলে এই জোরটা এসেছিল। তথ্যের অধিকার আইন, জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা, অরণ্যের অধিকার আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আইন তৈরি হয়েছিল। মিড-ডে মিল এবং ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্কিমের মতো প্রকল্পকেও বাড়ানো হয়েছিল অনেকখানি। কিন্তু, ইউপিএ-র দ্বিতীয় দফাতে এই উৎসাহে ভাটা পড়ল। আর, বর্তমান এনডিএ-র আমলে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের প্রশ্নটা সম্পূর্ণ দুয়োরানি। এই সরকারের সামাজিক নীতিকে মাত্র দুটো শব্দে ধরে দেওয়া সম্ভব: টাকা বাঁচাও!’’

কিন্তু, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? সামাজিক ক্ষেত্রে বিপুল গুরুত্ব দেওয়ার পর, খাদ্য থেকে শিক্ষা বা কর্মসংস্থান— এই প্রাথমিক জিনিসগুলোকে দেশের প্রতিটি মানুষের আইনি অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার পর যদি নির্বাচনে ভরাডুবি হয়, কংগ্রেসের আসনসংখ্যা এসে ঠেকে চুয়াল্লিশে, রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই বার্তা পড়ে নেবে না?

‘‘মুশকিল হল, বেশির ভাগ লোকই নির্বাচনের ফলাফলকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করেন।’’ বললেন দ্রেজ। ‘‘আমিও যদি সেই পথে হাঁটি, তবে তোমার প্রশ্নের গোছানো উত্তর দেওয়া যায়— ২০০৯ সালে ইউপিএ জিতেছিল এনআরইজিএ-র কল্যাণে; ২০১৪ সালে হেরেছিল, কারণ প্রথম দফায় সামাজিক প্রশ্নগুলির দিকে সরকারের যে নজর ছিল, দ্বিতীয় দফায় আর তা ছিল না। খাসা উত্তর। কিন্তু, একটা গোলমাল আছে। মানুষ কেন কোনও দলকে ভোট দেয়, বা দেয় না— সে বিষয়ে আমরা অতি সামান্য জানি। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ইউপিএ জিতেছিল এনআরইজিএ-র জোরে, এই দাবিটা ঠিক ততখানি ভিত্তিহীন, যতখানি ভিত্তিহীন এই দাবি যে ২০১৪ সালে বিজেপির জয় গুজরাত মডেলের মাহাত্ম্যে। বেশির ভাগ লোক জানেনই না গুজরাত মডেল বস্তুটি আসলে কী। যাঁরা জানেন বলে ভাবেন, তাঁদের মধ্যেও মতানৈক্য আছে। কাজেই, কোন মডেলের দৌলতে জয়, এটা নিছকই অনুমানের প্রশ্ন।

‘‘বরং, এই সব প্রশ্ন ছাপিয়ে যেটা দেখা যায়, সেটা হল সরকারের গণনীতির সঙ্গে নির্বাচনী রাজনীতির একটা সম্পর্ক। ভারতের সাধারণ মানুষ যে ছিটেফোঁটা সুবিধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছেন, তার বেশির ভাগটাই নির্বাচনী রাজনীতির হাত ধরে এসেছে। নির্বাচন এলেই নেতাদের সাধারণ মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যে তাঁদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তবে সর্বজনীন উন্নয়ন আর নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, বরং উল্টোটাই।’’

Jean Dreze Book
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy