Advertisement
E-Paper

এই নতুন মহাভারতে আর বিবিধ কণ্ঠস্বরের ঠাঁই নেই

মহারাষ্ট্রে ১৮৯৩ সালে গণপতি উৎসব হয়। ১৮৯৬ সালে শিবাজি উৎসব। এই উৎসব হিন্দু আবেগকে সংঘবদ্ধ করে। বালগঙ্গাধর তিলকের মহারাষ্ট্র থেকে ১৯০২ সালে বাংলায় আছড়ে পড়ে সেই আবেগ।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০১
দীর্ঘপ্রবাহী: সদ্য-স্বাধীন দেশে সংসদের বাইরে হিন্দু মহাসভার উগ্র জাতীয়তাবাদী দাবি-দাওয়ার রাজনীতি, হিন্দু জাগরণের কার্যক্রম। দিল্লি, ১৯৫২।

দীর্ঘপ্রবাহী: সদ্য-স্বাধীন দেশে সংসদের বাইরে হিন্দু মহাসভার উগ্র জাতীয়তাবাদী দাবি-দাওয়ার রাজনীতি, হিন্দু জাগরণের কার্যক্রম। দিল্লি, ১৯৫২।

মহারাষ্ট্রে ১৮৯৩ সালে গণপতি উৎসব হয়। ১৮৯৬ সালে শিবাজি উৎসব। এই উৎসব হিন্দু আবেগকে সংঘবদ্ধ করে। বালগঙ্গাধর তিলকের মহারাষ্ট্র থেকে ১৯০২ সালে বাংলায় আছড়ে পড়ে সেই আবেগ। শিবাজি হয়ে ওঠেন জাতীয় নায়ক। গিরিশ ঘোষ ‘ছত্রপতি শিবাজি’ নাটক লেখেন। তার অভিনয় হল কলকাতায়। শিবাজি নায়ক আর ঔরঙ্গজেব প্রতিনায়ক। নাটকের সংলাপ, ‘দেব মন্দির ভগ্ন, গোহত্যায় পৃথিবী কলুষিত। অনাচার। স্বধর্মপীড়ন। ব্রাহ্মণের মর্যাদা নেই। বর্ণাশ্রম লুপ্তপায়।... হে ছত্রপতি, তোমার নাম বিধর্মীর ভয়োৎপাদনকারী, স্বধর্মীর আনন্দবর্ধক,’ ইত্যাদি। তিলকের হিন্দু রাজ্য সংস্থাপনের ঘোষণা সে দিনও সমর্থনযোগ্য ছিল না, আজও নয়।

কংগ্রেসের মধ্যেও তিলক একা নন। মদনমোহন মালব্য থেকে বল্লভভাই পটেল অনেকেই বেশ কট্টর হিন্দুত্ববাদী ছিলেন। নেহরু এই কট্টর নেতাদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। স্বাধীনতা ও দেশভাগের সত্তর বছর পর আবার তৈরি হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতির সৌধ। সে দিন রাজনীতিতে যে ধর্মীয় মেরুকরণের বিষবৃক্ষ রোপণ হয় তাকে আবার ফুলে ফলে বড় করাই কি আমাদের কর্তব্য?

ঘটনাটা এমন নয় যে, এক দিন সকালে বিজেপি ভাবতে শুরু করল যে এই হিন্দু সমাজকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। বরং সঙ্ঘপরিবার ধীরে ধীরে এই কাজ করে চলেছে বহু দিন ধরে। গোধরা কাণ্ডের পর সে সম্প্রসারণ দেখেছি চোখের সামনে। শিবাজি বা গণপতি উৎসবের শিকড় থেকেই আজ শক্তি সংগ্রহ করছে মোদীর বিজেপি। নেহরুর অনেক ব্যর্থতা, তবু তিনি কংগ্রেসের এই হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে আধুনিক উন্নয়নমুখী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনে মন দিতে চেয়েছিলেন। মোদী-অমিত শাহ আজ উন্নয়নের কথা যতই বলুন, দলের সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশল তৈরি করছেন কিন্তু সেই উগ্র হিন্দুয়ানার পথেই।

বিজেপির সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশলে তাই দেখছি ভারতীয় ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা। অতীতে অত্যাচারিত দলিত সমাজ হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অত্যাচারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দলিত সমাজের বড় অংশ বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার পিছনেও ছিল এই ইতিহাস। এখন এক অখণ্ড হিন্দু পরিবার গড়ার চেষ্টা হচ্ছে যা ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি। শুধু মায়াবতীকেই নয়, জাতপাত ভিত্তিক বহু আঞ্চলিক দলকেই সমস্যায় ফেলতে পারে এই রাজনীতি। একদা এই নানা জাতের বিশেষত দলিত নিম্নবর্ণ ছিল কংগ্রেসেরই ভোট ব্যাঙ্ক। পরে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বে অভিজাত উচ্চবর্ণের আধিপত্য আসায় নানা রাজ্যে নানা আঞ্চলিক দল জাতপাতের ভোট কেড়ে নেয় কংগ্রেসের কাছ থেকে। আজ বিজেপি সেই হরিজন ভোটের উপর সম্পূর্ণ দখল চাইছে। এক দিকে মোদীর নিয়ন্ত্রণ। অন্য দিকে শক্তিশালী হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা। সেই জাতীয়তাবাদের মধ্যেই জড়িয়ে আছে দেশের আর্থিক উন্নয়নের সমাধান। মোদী অমিত শাহর এই রাজনীতি ভাষ্য মূলত নেহরুর রাজনীতির ভাষ্যের বিপরীত। সত্যি সত্যিই তা সফল হবে কি না সেটাই বিচার্য বিষয়। রাম মাধবের মতো নেতারা প্রকাশ্যেই বলছেন তথাকথিত মেকি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আর উদারগণতন্ত্রীদের সমালোচনা মোদীর ভারত দর্শনের প্রতিষ্ঠায় আরও সহায়ক হচ্ছে। এই ‘গেল গেল’ রব হল এক ধরনের অ্যান্টিথিসিস। মোদী তথা বিজেপি-সঙ্ঘের ভারত-ভাবনাকে সেটা আরও জনপ্রিয়, আরও শক্তপোক্ত করছে।

এখন এক নতুন মহাভারত গড়ার পরিকল্পনা। সাম্রাজ্য বিস্তার ভারতের ইতিহাসে নতুন নয়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সমুদ্রগুপ্ত, সম্রাট অশোক এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের উপর ভারতীয় আধিপত্য কায়েম করেছিলেন। যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাত। পরে অশোকের ধর্মীয় সংহতির বার্তা। সম্রাট আকবরও এক আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের মহাধিনায়ক হয়ে ওঠেন। রাজতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র আসে। আসে স্বরাজ। বহুদলীয় গণতন্ত্র হলেও সে দিন আধিপত্য ছিল নেহরু-গাঁধীর কংগ্রেসের। কংগ্রেসের মুখপাত্র ভি এন গ্যাডগিল বলতেন, যে কোনও গ্রামে যাও, দেখবে ১৫ পয়সার হলুদ পোস্টকার্ড, শুনবে লতা মঙ্গেশকরের গান আর পাবে কংগ্রেসের একজন কর্মী। সেই কংগ্রেসের ক্ষয় প্রথম প্রকাশ্যে এল নেহরুর মৃত্যুর পর ’৬৭ সালের নির্বাচনে। তার পর কয়েক দশক ধরে কংগ্রেসের অবক্ষয়, জনসঙ্ঘ-বিজেপির ক্রমিক উত্থানের কাহিনি তো সুবিদিত।

২০১৪ সালের ভোটে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি প্রথম দিল্লির মসনদে একক ভাবে ক্ষমতায় এসেছে মূলত হিন্দি বলয়ের শক্তিতেই। এর সঙ্গে যোগ হয় গুজরাত-মহারাষ্ট্রের মতো পশ্চিম প্রান্ত। এখন কিন্তু মোদী-শাহর সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার ভারতের পূর্ব, উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ ভারত। অতীতে কখনওই এ ভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার নেহরু মডেলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারেনি বিজেপি। হতে পারে বাজপেয়ী যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন এনডিএ-কে রক্ষা করার জন্য বিজেপি তার রাজনৈতিক হিন্দুত্ব কর্মসূচিকে শিকেয় তুলে রেখেছিল। শরিক দলের সঙ্গে বাজপেয়ীর বিজেপি চুক্তি করেছিল যে রামমন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আর ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, এই তিনটে বিষয়ই আপাতত ঠান্ডাঘরে চলে গেল।

২০১৪ সাল থেকে মোদী-রাজনীতির ভাষ্যটাই বদলে গেল। আগে প্রচলিত ধারণা ছিল বিজেপি মানেই উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট। ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য সম্প্রদায়ের দল ছিল বিজেপি। সংকীর্ণ জাতপাতের গণ্ডি থেকে দলকে বার করে উন্নয়নের প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলে মোদী বিপুল জনসমাজকে কাছে টানতে পারলেন। এ বার উত্তরপ্রদেশের জয়ের পর বিজেপি যে ভাবে সর্বভারতীয় দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য এগোচ্ছে, তাতে ১৯৪০ সালের হিন্দু মহাসভার জনপ্রিয় স্লোগান হিন্দি হিন্দু এবং হিন্দু্স্থান আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

রাজনীতিতে পূর্ণচ্ছেদ নেই। মোদী-শাহর এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ভারতের সাবেকি বহুত্ববাদী কাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংস্কৃতির নামে গোটা দেশে নানা মতের পারস্পরিক আদানপ্রদানের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে। কথোপকথনের বদলে এখন আধিপত্য এক-বক্তার সংলাপের। এই নতুন মহাভারতে আর বিবিধ কণ্ঠস্বরের ঠাঁই নেই।

Religious polarization development
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy