Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাংলার বিরল ব্যক্তিত্ব রেভারেন্ড লালবিহারি দে

শুধু সাহেব সাজার জন্য বা হিন্দু সমাজে নিগৃহীত হওয়ার জন্য তিনি খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেননি। তাঁর জীবনীকার জি ম্যাকফারসনের মতে, আধুনিক শিক্ষালাভের ফলে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারান। লিখছেন অচিন্ত্যকুমার দত্তশুধু সাহেব সাজার জন্য বা হিন্দু সমাজে নিগৃহীত হওয়ার জন্য তিনি খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেননি। তাঁর জীবনীকার জি ম্যাকফারসনের মতে, আধুনিক শিক্ষালাভের ফলে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারান।

রেভারেন্ড লালবিহারি দে।

রেভারেন্ড লালবিহারি দে।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:০৩
Share: Save:

দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব রেভারেন্ড লালবিহারি দে। বর্ধমান শহরের কাছে সোনাপলাশী গ্রামে দরিদ্র সুবর্ণবণিক পরিবারে ১৮২৪ সালে তাঁর জন্ম। দূরদর্শী পিতা লালবিহারিকে শৈশবেই কলকাতায় নিয়ে যান ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্যে। ১৮৩৪ সালে ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’ নামে মিশনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন লালবিহারি। পরে পিতৃবিয়োগ ও দারিদ্র্যের মতো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও উচ্চশিক্ষা লাভে উদ্যোগী হন এই মানুষটি।

সে সময় হেয়ার স্কুলের শ্রেষ্ঠ ছাত্রগণ বিদ্যালয়ের খরচে হিন্দু কলেজে পড়ার সুযোগ পেতেন। এই অভিপ্রায়ে লালবিহারী হেয়ার স্কুলে ভর্তি হতে সচেষ্ট হন। কিন্তু ১৮৩৮ সালে ডেভিড হেয়ার তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন। তারপরে লালবিহারি ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’-এ পাঠ সমাপ্ত করেন। ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি, সেখানে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতও হন।

শুধু সাহেব সাজার জন্য বা হিন্দু সমাজে নিগৃহীত হওয়ার জন্য তিনি খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেননি। তাঁর জীবনীকার জি ম্যাকফারসনের মতে, আধুনিক শিক্ষালাভের ফলে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারান। তা ছাড়া, ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’-এর শিক্ষাপ্রণালি এবং শিক্ষকদের আন্তরিকতা তাঁকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। সর্বোপরি, তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহেন্দ্রলাল বসাক এবং কৈলাসচন্দ্র মুখোপাধ্যায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তিনিও এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। দারিদ্র ও উচ্চশিক্ষাভিলাষই সম্ভবত তাঁকে এ পথে টেনে নিয়ে এসেছিল বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন।

তাঁর জন্মস্থান।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, উনিশ শতকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বহু তরুণ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একাংশের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার এবং নানা রীতিনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে খ্রিস্টধর্ম বা ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। লালবিহারির ধর্মান্তরিত হওয়াও সে প্রবণতারই ফল। ধর্ম ত্যাগ করলেও তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেননি। চৈতন্যদেবের ধর্মীয় ভাবাদর্শের ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলেন।

১৮৬৭ সালে লালবিহারি যাজক বা ধর্মপ্রচারকের দায়িত্ব ত্যাগ করে সরকারি শিক্ষাবিভাগের সঙ্গে যুক্ত হন। যোগ দেন বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে। ধর্মোপদেশক থেকে শিক্ষক হওয়ার পিছনে অনেকে আর্থিক কারণকে দায়ী করেন। তবে লালবিহারির শিক্ষক পদে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে শিক্ষাদানের বাসনাও কাজ করেছিল বলে ইতিহাসবিদেরা মনে করেন। ১৮৭২ সালে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে তিনি হুগলি কলেজে যোগ দেন এবং ১৮৮৯ সালে অবসর নেন।

বর্ধমানের এই কৃতী সন্তান শিক্ষকতার পাশাপাশি, সাহিত্যেও তাঁর কৃতিত্ব প্রমাণ করেছিলেন। ইংরেজি ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ও পাণ্ডিত্যে অনেক ইংরেজও মুগ্ধ হয়েছিলেন। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এর মতো পত্রিকাতেও তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। সাহিত্যে লালবিহারির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘BENGAL PEASANT LIFE’ (‌‌বেঙ্গল পেজ়েন্ট লাইফ) (১৮৭৮) গ্রন্থটি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমালোচকদের মতে, দরিদ্র, বাঙালি কৃষকের জীবনেতিহাস এর চেয়ে চমৎকার ভাবে অন্য কেউ বিবৃত করেননি। এটি বিদ্বজ্জনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লন্ডনের ‘ইংলিশম্যান’ এবং ‘মর্নিং‌ পোস্ট’ পত্রিকাতেও এই গ্রন্থ এবং লেখকের সাহিত্য প্রতিভা প্রশংসিত হয়েছিল। প্রশংসাকারীর তালিকায় ছিলেন বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনও।

খ্রিস্টান হলেও মনেপ্রাণে লালবিহারি ছিলেন বাঙালি। তাঁর মতে, বাঙালিরা অন্য ভারতীয়দের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। ধর্ম থেকে শুরু করে বিনোদন—সব বিষয়কে কেন্দ্র করেই তিনি বই লিখেছিলেন। যেমন ‘বেঙ্গলি ফেস্টিভ্যাল অ্যান্ড হলিডে’, ‘স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস অব বেঙ্গল’, ‘চৈতন্য অ্যান্ড বৈষ্ণব অব বেঙ্গল’, ইত্যাদি। কোনও কোনও ইংরেজ অধ্যাপক যখন বাঙালির ইংরেজি ভাষার ভুলত্রুটি চিহ্ণিত করে ‘বাবুর ইংরেজি’ বলে উপহাস করতেন তখন লালবিহারি তাঁদের প্রতিহত করতে ইংরেজি ভাষার দুর্বলতা তুলে ধরতেন। তবে ‘বেঙ্গল ম্যাগাজিন’ নামক পত্রিকায় তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েও কথা বলেছিলেন লালবিহারি। বাংলার লোক (উপ)কথাকে কেন্দ্র করে তাঁর অনেক লেখা রয়েছে। ‘ফোকটেলস অব বেঙ্গল’ (১৮৮১) বইটি তাঁকে লোককথার অন্যতম রচয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলার কৃষকের দুরবস্থার উপরেও তিনি আলোকপাত করেছিলেন এবং সে পরিস্থিতির জন্য জমিদারি শোষণের দিকে আঙুল তুলেছিলেন।

উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন রেভারেন্ড লালবিহারি দে। বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় এবং নৈতিক জীবনের বিশুদ্ধিকরণ ও বিকাশের জন্য তিনি উদগ্রীব ছিলেন এবং শিক্ষার অগ্রগতির মাধ্যমেই যে তা সম্ভব সে কথা বিশ্বাসও করতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার সমসাময়িক অনগ্রসরতা সম্ভবত তাঁকে বিচলিত করেছিল। তাই তাঁর নানা প্রবন্ধে সে যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতির দুর্বলতা ও তা দূর করার কৌশল বারবার আলোচিত হয়েছে। ‘বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোশিয়েশন’ এবং ‘বেথুন সভা’য় তিনি এ ধরনের প্রবন্ধও পাঠ করেছিলেন। এ দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তারের উদ্দেশে তিনি সরকার ও জমিদারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ করেছিলেন। দেশের সর্বত্র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বাধ্যতামূলক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার আবেদন জানিয়েছিলেন। এর ফলে, বাংলার গরিব ঘরের সন্তানেরা শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে বলে তিনি মনে করেছিলেন।

লালবিহারি দে-র বিদ্যানুরাগকে সম্মান জানিয়ে তৎকালীন গভর্নর লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ডসন টেম্পল তাঁর ‘ম্যান অ্যান্ড ইভেন্টস অব মাই টাইমস ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘তাঁর চরিত্রে স্বনির্ভরতা, লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদ এবং নিজের প্রজন্মের জন্য ভাল কিছু করার তাগিদ এক সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। তাঁর লেখায় তাঁর দেশের দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনকথা বাস্তব ও মূর্ত হয়ে উঠত’।

এমন এক মনীষীর স্মরণে স্বাধীনতার ৬১ বছর পরেও সরকারি ভাবে বিশেষ কিছু করা হয়নি। বর্ধমানে তাঁর স্মৃতি বলতে সোনাপলাশির রেভারেন্ড লালবিহারি দে স্মৃতি পাঠাগার এবং রেভারেন্ড লালবিহারি দে সরণি। কিন্তু তাঁর কথা আমরা কার্যত ভুলতে বসেছি। যদিও যথাযথ গুরুত্ব পেলে তাঁর কর্মকাণ্ড বর্তমান প্রজন্মের কাছেও সমাদৃত হবে বলে মনে হয়।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Journalist Reverend Lal Behari Dey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE