Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কত ধানে কত স্মৃতি

ধান উৎপাদন, তা থেকে চাল তৈরি, নানা পদের রান্না ও পরিবেশন, এই সবই আমাদের শিল্পবোধ ও জীবনরসে জারিত। হারিয়ে-যাওয়া জীবনের গল্প, যা সাহিত্য, গান, ছবি, লোককথার মধ্যে থেকে গিয়েছে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অন্বেষা সরকার
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৯ ০০:৪৪
Share: Save:

পান্তাভাত, পেঁয়াজ, খুব ঝাল লঙ্কা আর নুন। ডালসেদ্ধ-ভাত, আলুভাজা আর ঘি। পোলাও আর মাংস। পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করা ভাতের স্মৃতি বেঁচে থাকে বছরের পর বছর। কী দিয়ে কী খেয়েছিলাম, কে কেমন করে খাইয়েছিল, তার অনুষঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে ব্যক্তির জীবনকথা, তেমনই জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের ইতিহাস। প্রতিটি ব্যক্তি তার চলমান সংগ্রহশালা বা আর্কাইভ। তাই স্মৃতিচারণে হারিয়ে-যাওয়া খাদ্য, খাদ্যরীতি, পাকপ্রণালীর কথা উঠে আসে।

ধান উৎপাদন, তা থেকে চাল তৈরি, নানা পদের রান্না ও পরিবেশন, এই সবই আমাদের শিল্পবোধ ও জীবনরসে জারিত। হারিয়ে-যাওয়া জীবনের গল্প, যা সাহিত্য, গান, ছবি, লোককথার মধ্যে থেকে গিয়েছে। এমন সমবেত স্মৃতির হাত ধরে সম্প্রতি কোচি মুজিরিস বিয়েনাল আন্তর্জাতিক আর্ট ফেস্টিভ্যালে (২০১৮-২০১৯) তৈরি হয়েছিল ‘এডিব‌‌্ল আর্কাইভ‌্স’। তাতে ছিল দেশের নানা প্রান্তের অবলুপ্তপ্রায় চাল। কেবল কৃষিবিজ্ঞানীর ভাঁড়ার নয়। যিনি ধান বুনছেন, ধান থেকে চাল বানাচ্ছেন, রান্না করছেন আর যিনি খাচ্ছেন, সকলের মিলিত ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতির সংগ্রহশালা যেন!

ভারতের খাদ্য-সংস্কৃতির অভিন্ন অঙ্গ চাল। অথচ নানা রকমের ভাত অজান্তেই স্রেফ ‘স্মৃতি’ হয়ে যাচ্ছে। সবুজ বিপ্লব আনল হাইব্রিডের চাষ। তার পর হাজারেরও বেশি রকমের দেশি চাল অবলুপ্ত হয়েছে। তার কিছু কৃষক ও গবেষকদের প্রচেষ্টায় ঠাঁই পেয়েছে ‘সিড ব্যাঙ্ক’-এ। ধানের বীজ রেখে দেওয়া যায় না, সংগৃহীত বীজকে ফলনশীল রাখতে কৃষকরা জৈবচাষ করে এই ব্যাঙ্ক সচল রাখেন।

এমন নানা চাল সম্পর্কে জানা গেল কত অজানা তথ্য। তামিলনাড়ুর একটি চাল ‘কাট্টুয়ানম’, তামিলে যার অর্থ বন্য হাতি। ধানগাছ এত লম্বা আর ঘন হয় যে ধানখেতে বুনো হাতি লুকিয়ে থাকতে পারে। মূলের জলধারণ ক্ষমতা বেশি, খরা প্রতিরোধ করতে পারে। অল্প খেলেই পেট ভরে থাকে দীর্ঘ সময়। বাত ও হৃদ্‌রোগের ওষুধ তৈরির জন্য এই চাল ব্যবহার হত, অনেকটা বাংলার কবিরাজশাল চালের মতো। ‘দোদা বারি নেল্লু’, ওট্‌সের মতো লাল চাল, ফাইবার বেশি, খুবই পুষ্টিকর। মেঠো স্বাদের ঘন খয়েরি রঙের কেরলের ‘পোক্কালি’ চাল ব্যাকওয়াটারে চাষ হয়। জলের তলায় তিন সপ্তাহও থাকতে পারে, আর নোনাজলে বেড়ে ওঠে বলে স্বাদে-গুণে ভিন্ন। ধান তুলে নেওয়ার পর ধান জমিতে ছোট চিংড়ির চাষ ভাল হয়।

আর ছিল উত্তরবঙ্গের কালা ভাত। আয়রনে ঠাসা, গর্ভবতীদের জন্য আবশ্যক ছিল এই চাল। শরীর ঠান্ডা রাখত। কালো রঙের আর একটি চাল ‘বার্মা ব্ল্যাক রাইস’। উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচলিত, নাগাল্যান্ডে শুয়োরের মাংসের সঙ্গে অনবদ্য জুড়ি। অসমে শীতকালে হাঁসের মাংসের সঙ্গে এই ভাত খাওয়া হয় শরীর গরম রাখতে। প্রায় পঁয়ত্রিশ রকমের চাল খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল ‘এডিব‌‌্ল আর্কাইভস’।

তা বলে সবটাই অতীতের কারবার নয়। চালের স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ আর প্রকৃতি বুঝে ‘ফিউশন’ করেন এই প্রকল্পের অন্যতম কিউরেটর শেফ অনুমিত্রা ঘোষ দস্তিদার। কেরলের কিলি মিন, কারি মিন, মান্দলি, চালা, নরম খোলার কাঁকড়া কিংবা চিংড়ির নানা পদের সঙ্গে ভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন চরিত্রের চালের ভাত। যেমন, রত্নাচুরি চালের ভাত যে কোনও সবজি বা আমিষের শ্রেষ্ঠ স্বাদ ও ঘ্রাণ বার করে আনে। তার সঙ্গে ঠিক কী কী পদ খেলে জমে যাবে। খসখসে লাল চাল, বা আঠালো কালো চাল, কিংবা খুব সুঘ্রাণ ভাতের সঙ্গে ঠিক কোন কোন পদ ভাল যাবে, সে বিষয়ে অনুমিত্রা বিশেষজ্ঞ।

শ্রীলঙ্কার শেফ প্রিয়া বালা রত্নাচুরি চাল আর নারকোলের দুধ দিয়ে বানালেন শ্রীলঙ্কার কিরি ভাত, আর তা পরিবেশন করলেন মেঘালয়ের শুকনো চিংড়ি মাছের আচার দিয়ে। অধ্যাপক-লেখক কিরণ ভুসি কালা ভাত দিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘ম্যাঙ্গো রাইস’। শেফ প্রিমা কুরিয়েন কোডাম্‌পলি চাল আর কাঁচা সবুজ গোলমরিচ দিয়ে রান্না করতে করতে ফিরে যাচ্ছিলেন ছেলেবেলার স্মৃতিতে। ছুটির সময় দেশের বাড়িতে দিদিমার কাছে চালের বিভিন্ন পদ — পুট্ট, আপ্পাম, ইডিয়াপ্পাম, পাত্‌রি— খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগান থেকে দারচিনি, গোলমরিচ, জায়ফল তুলে আনাটা ছিল ছোটদের খেলা। যে বেশি তুলে আনবে, সে পাবে রাইস কেকের বড় ভাগটা।

আগে আলাদা আলাদা পদের জন্য আলাদা আলাদা চালের ব্যবহার হত। আজ কমতে কমতে ঠেকেছে দু’টি বা তিনটিতে। পিঠে-পুলি, পায়েস-পোলাওয়ের জন্য গোবিন্দভোগ, আর দৈনন্দিনের জন্য বাজার-লভ্য কিছু সেদ্ধ চাল। আর রয়েছে বাসমতী চাল, যার আগমন হাল-আমলে, কিন্তু প্রসিদ্ধি ব্যাপক। কেন এই দশা? অনুমিত্রা বলছিলেন, ইটালিতে ‘রিসোতো’, বা জাপানে ‘সুশি’ রান্নার জন্য নানা রকম চাল বাজারে পাওয়া যায়। অথচ এ দেশের বাজার ছেয়ে গিয়েছে শুধুই হাইব্রিড বাসমতী চালে।

চাষিরা কিন্তু এখনও অনেক বিরল প্রজাতির চাল উৎপাদন করেন। অনেকে কেবল জৈব সার ব্যবহার করেন। দেশি পদ্ধতিতে চাষের সঙ্গে জুড়ে আছে প্রচুর নারী শ্রমিক, যাঁদের কথা খুব কম আলোচিত হয়। এঁদের স্মৃতিতে ধান ও ধান-সংক্রান্ত যে জ্ঞান রয়েছে, তার কতটুকু থাকবে? বাংলায় যে উড়কি ধানের মুড়কি, শালি ধানের চিঁড়ে আর বিন্নি ধানের খই ছিল, এ কথা কি আমরা ভুলে যাব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rice Food Indian culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE