Advertisement
E-Paper

বাঙালির বিপদ বাড়ছে

নাগরিক পঞ্জি-টঞ্জি যে আসলে মুসলমান খেদানোর ছদ্মনাম, প্রায় কোনও রাখঢাক না করেই জানিয়ে গিয়েছেন অমিত শাহ। অসমে চল্লিশ লক্ষ মানুষকে ভিটেছাড়া করেই খেলা ফুরোবে, সে ভরসা শাহ দেননি।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৮ ০১:৪৭

অমিত শাহ-র বক্তৃতা শুনলেন?’’ প্রশ্ন করে শিশির। দিন কয়েক কেটে গিয়েছে কলকাতায় বিজেপি সভাপতির সমাবেশের পরে। মাঝে কয়েক দিন ডুব মারার পর আজই ফের আড্ডায় এলেন শিবুদা।

‘‘শুনলাম।’’ চায়ের গেলাস নামিয়ে উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘বুঝলাম। ২০১৯-এর জন্য বিজেপির রাম মন্দির লাগবে না, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগবে না, এমনকি বড় মাপের দাঙ্গাও লাগবে না। শুধু বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর জুজু দেখিয়েই হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ কী ভাবে করতে হয়, অমিত শাহ তার নমুনা দিয়ে গেলেন।’’

‘‘ভেবে দেখুন, তৃণমূলের দুর্নীতির প্রসঙ্গটা অবধি শুধু বুড়ি ছুঁয়ে গেল। সারদা-নারদ নিয়ে গোটা কয়েক সেনটেন্স, ব্যস। মানে, তার চেয়ে ঢের বড় অস্ত্র এখন এনআরসি, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিদেয় করার হুমকি।’’ সূর্য বলল। গেল শনিবার টেলিভিশনে বিজেপি সভাপতির ভাষণ শোনা ইস্তক মাথার মধ্যে কিলবিল করছে চিন্তাটা। নাগরিক পঞ্জি-টঞ্জি যে আসলে মুসলমান খেদানোর ছদ্মনাম, প্রায় কোনও রাখঢাক না করেই জানিয়ে গিয়েছেন অমিত শাহ। অসমে চল্লিশ লক্ষ মানুষকে ভিটেছাড়া করেই খেলা ফুরোবে, সে ভরসা শাহ দেননি।

‘‘এনআরসি-তে যাদের নাম উঠল না, তাদের কি সত্যিই দেশ থেকে তাড়াবে?’’ তপেশ প্রায় সূর্যর মনের কথাটাই বলে উঠল। ‘‘এতগুলো মানুষ কোথায় যাবে, বাংলাদেশে?’’

‘‘বাংলাদেশ নেবে না, জানিয়েই দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মতো দেশহীন হবে এই লোকগুলো।’’ শিশির উত্তর দেয়।

‘‘সেটা সম্ভবত হবে না, বুঝলি।’’ উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘নরেন্দ্র মোদী আছেন, কিন্তু গণতন্ত্রও আছে এখনও। দেশ থেকে তাড়াতে পারবে না মানুষগুলোকে। তবে, ক্যাম্পে আটকে রাখতে পারবে বিলক্ষণ। জমি-বাড়ি কেড়ে নিয়ে, জীবিকার অধিকার কেড়ে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখবে। পিঁজরাপোলে বন্দি।’’

সবাই চুপ করে থাকে। গোপালের দোকানের আড্ডা এমন নীরব কখনও থেকেছে? মনে করতে পারে না শিশির। গোপাল আর এক দফা চা দিয়ে যায় একটু পরে। শিবুদা একটা সিগারেট ধরান।

‘‘উন্নয়ন, হ্যাঁ? সবকা সাথ, সবকা বিকাশ! কতগুলো মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ ঘেঁটে দিচ্ছে অমিত শাহরা, একটা ভোটে জেতার জন্য, বুঝতে পারছিস?’’ নীরবতা ভাঙেন শিবুদা।

‘‘বলেছেন তো অমিত শাহ। দেশের নাগরিকদের স্বার্থের কথা ভাববে সরকার, অনুপ্রবেশকারীদের নয়।’’ তপেশের গলায় শ্লেষ।

‘‘অনুপ্রবেশকারীদের কথা বাদই দে। দেশের মানুষের কথাই ধর। একদম পাক্কা ভারতীয় নাগরিক। ধর, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান, অথবা অসমের বাঙালি, যে কোনও ধর্মের। অথবা মুম্বই-দিল্লি-বেঙ্গালুরু-রাজস্থান-কেরলে শ্রমিকের কাজ করতে যাওয়া বাঙালি। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু বাঙালিও। গরিব, লেখাপড়া না জানা, খেটে খাওয়া বাঙালি। তাদের উন্নয়নের কতখানি ক্ষতি হবে, ভেবে দেখেছিস?’’ শিবুদা বলতে থাকেন। ‘‘বাঙালি খেদানোর ইতিহাস তো এই দেশে খুব একটা কম নেই। আগে শুধু রাজনীতির ধাক্কা ছিল। এখন তো রাষ্ট্রই অস্ত্র তুলে দিচ্ছে হাতে। অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিতে পারলেই হল।’’

‘‘বাঙালিমাত্রই অনুপ্রবেশকারী বলে তাড়িয়ে দেবে, এতটা বাড়াবাড়ি বোধ হয় হবে না, শিবুদা।’’ তপেশ বলে।

‘‘হওয়ার দরকারও নেই।’’ শিবুদা আরও একটা সিগারেট ধরান। ‘‘তাড়িয়ে দিতে পারে, এই ভয়টাই যথেষ্ট। ভয়ের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কতখানি, শুনবি? আজ না হোক, পরশুর পরের দিন এসে আমাকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে ক্যাম্পে, বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে এত দিনের চেনা জীবন, জীবিকা থেকে— এই ভয় কতখানি ক্ষতি করতে পারে উন্নয়নের, বিশেষ করে গরিব মানুষের, শুনবি?’’

শিবুদা থামেন। বাকিরাও চুপ। বাইরে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। গুটিয়ে রাখা পলিথিন শিটগুলোকে গোপাল তাড়াতাড়ি টেনে নামিয়ে দেয়।

‘‘কোনও দিন হাওড়া স্টেশনে গিয়ে দেখিস, দূরপাল্লার ট্রেনের আনরিজ়ার্ভড কামরার জন্য লম্বা লম্বা লাইন প়ড়ে’’, বলতে থাকেন শিবুদা। ‘‘স্বল্পশিক্ষিত যুবকরা অন্য রাজ্যে কাজ খুঁজতে যায়। বেশির ভাগই দেখবি মুসলমান। রাজমিস্ত্রির কাজ, জোগাড়ের কাজ, জরির কাজ। হোটেল রেস্তরাঁয় বেয়ারার কাজ। ধর, যারা এই কাজগুলো দেয়, তাদের মনে যদি ভয় ঢুকে যায় যে এই লোকগুলো আসলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, পুলিশ এসে এদের ধরে নিয়ে যেতে পারে, ছেলেগুলো আর কাজ পাবে? কে আর সাধ করে পুলিশের ঝামেলায় পড়তে চায়? বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে, যেখানে সস্তার শ্রমিক প্রায় না খুঁজতেই মেলে? এই কাজগুলোও যদি না পাওয়া যায়, কী পড়ে থাকে? দিল্লি-গুরুগ্রামে রিকশা চালানো? সেটাও থাকবে ভেবেছিস? কাল যদি বস্তিতেও এরা বাড়িভাড়া না পায়? এদের রোজগারের টাকায় সংসার চলে, ছেলেমেয়েরা হয়তো স্কুলে যায়। সেটা বন্ধ হতে ঠিক কত ক্ষণ সময় লাগবে, ভেবে দেখেছিস?’’

শিবুদার মুখটা থমথম করে। বলতে থাকেন, ‘‘সবাইকে তো তাড়ানোর দরকার নেই। এমনকি, সবাইকে অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়ারও দরকার নেই। দরকার শুধু এই ধারণাটুকু তৈরি করে দেওয়া যে বাঙালি মুসলমান মানেই তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর, সেই প্রশ্ন থাকা মানেই তাকে এড়িয়ে চলা ভাল। ভিনরাজ্যেও যেতে হবে না, বুঝলি। গ্রাম থেকে কোনও মুসলমান যুবক কলকাতায় কাজ খুঁজতে এলেও যে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না শহরের লোক, সেই গ্যারান্টিও তো নেই। বরং, উল্টোটাই বেশি সম্ভব। মুসলমানদের ভাতে মারার এমন চমৎকার ব্যবস্থা— চমৎকার রাষ্ট্রীয় কৌশল— বার করতে মাথা লাগে রে।’’

দোকানে আর কোনও খদ্দের নেই দেখে টেবিলে আর এক দফা চা দিয়ে গোপালও এসে বসে এক কোণে। শিবুদা চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে থাকেন, ‘‘সেন্ধিল মুলাইনাথনের কথা বলেছি আগে? যে কয়েক জন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এখন বিশ্বের প্রথম সারিতে আছেন, সেন্ধিল তাঁদের মধ্যে এক জন। হার্ভার্ডে পড়ান। সেন্ধিল একটা আশ্চর্য কথা বলেছিলেন— গরিব মানুষ গরিব বলেই জীবনে হরেক ভুল সিদ্ধান্ত করে, আর তার ফলে গরিবই থেকে যায়। কথাটা শুনতে প্রায় কমন সেন্সের মতো, তাই না? যেটা আনকমন, সেটা হল সেন্ধিলদের ব্যাখ্যা। মানুষের মাথার ওপর দারিদ্র কী ভাবে প্রভাব ফেলে, তার ব্যাখ্যা। সেন্ধিলদের বক্তব্য, প্রত্যেকটা মানুষের মাথার একটা নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা রয়েছে। তার বেশি চাপ পড়লে মাথা তা সামাল দিতে নাচার। সেন্ধিলরা মাথার এই ধারণক্ষমতার নাম দিয়েছেন ‘ব্যান্ডউই়ডথ’। ইন্টারনেটের যেমন ব্যান্ডউইডথ থাকে, তেমন। যে কোনও আশঙ্কা— সামনে ঝুলতে থাকা বিপদের আশঙ্কা— মানুষের ব্যান্ডউইডথ-এর অনেকখানি দখল করে নেয়।

‘‘গরিব মানুষের জীবনের সব চেয়ে বড় আশঙ্কা বুঝতেই পারছিস, তার দারিদ্র। মহাজনের টাকা ফেরত দেওয়ার চাপ, সন্তানের স্কুলের মাইনে জোগাড়ের চাপ, হঠাৎ অসুস্থতায় ধার হয়ে যাওয়ার চাপ। গরিব মানুষের জীবন প্রতি নিয়ত একটা না একটা চাপের নীচে থাকে। ফলে, কমতে থাকে তার ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে যে কাজটা করে ফেলা উচিত, ব্যান্ডউই়ডথ-এর ওপর জমে থাকা চাপ মানুষকে সেই কাজটা করতে দেয় না। আর, সেই ‘ঠিক কাজ’গুলো করতে না পারার অনিবার্য ফল, উন্নয়নের ক্ষতি। প্রতিটা ভুলে আরও এক ধাপ করে পিছিয়ে পড়া উন্নয়নের দৌড় থেকে।’’

‘‘বোধ হয় ধরতে পারছি আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন’’, শিবুদার কথার সূত্র ধরে নেয় তপেশ। ‘‘অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত হওয়ার নিরন্তর আশঙ্কা আরও একটা বোঝা চাপাবে মানুষের মাথার ব্যান্ডউইডথ-এর ওপর। এমন আশঙ্কা, যা পিছু ছাড়বে না কিছুতেই। আর, সেই বাড়তি বোঝা আরও খানিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে নষ্ট করবে।’’

‘‘একদম। একটা গরিব বাঙালি মুসলমান পরিবারের কথা ধর। জমিজিরেত তেমন নেই। এমনিতেই ধারকর্জের জীবন— পান্তাই জোটে না, তাতে নুন জোগানোর প্রশ্নও নেই। তার ওপর, নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র আছে খানিক এ দিক ও দিক, কিন্তু রাষ্ট্র তা মানবে কি না, সেই নিশ্চয়তা নেই। সেন্ধিল মুলাইনাথনদের কথার মধ্যে যদি তিলমাত্র সত্যি থাকে, তবে এই পরিবারটা তলিয়ে যাবে আরও অন্ধকারে। ওষুধ খেতে ভুলে যাবে হামেশা; টুকরোটাকরা রাষ্ট্রীয় সুবিধা যদি প্রাপ্যও হয়, তবু ভুল হয়ে যাবে সময়ে তার জন্য দরখাস্ত করতে; খেতে আগাছা জমে থাকবে, সাফ করা হয়ে উঠবে না। একটা কথাও মনগড়া নয় আমার, গরিব মানুষের ব্যান্ডউইডথ-এ বাড়তি চাপ পড়লে ঠিক এগুলোই হয়, গবেষণা বলছে। রোজগার আরও কমবে। আরও কোপ পড়বে বাচ্চাদের পিছনে খরচের ওপর, মেয়েদের চিকিৎসায়। তাতে উন্নয়নের কতখানি ক্ষতি, অমিত শাহও জানেন।’’ টানা কথাগুলো বলে থামেন শিবুদা।

বৃষ্টি পড়েই চলেছে। রাত বাড়ছে। অন্ধকার।

NRC Assam Amit Shah
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy