Advertisement
E-Paper

ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে

প্রস্তাবিত এই সংস্কারের প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত সংস্কৃত ভাষার অন্তর্গত বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণা-ক্ষেত্রের প্রসার, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন টোল ও পণ্ডিতমশাইদের বর্তমানের চরম দুর্দশা দূরীকরণ।

অতনুশাসন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৮ ০০:৪৭

কলকাতা সংস্কৃত কলেজ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে উন্নীত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কার্যধারার পাশাপাশি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের টোল-চতুষ্পাঠী সংক্রান্ত পঠনপাঠন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেও নিয়ে আসা হবে বলে জানা গিয়েছে। টোল-চতুষ্পাঠী সংক্রান্ত পাঠ্যক্রমের সংস্কার দীর্ঘ দিন ধরেই প্রয়োজন ছিল। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা পর্বে এ ব্যাপারে উপযুক্ত এক মুহূর্তের সম্মুখীন হওয়া গিয়েছে ধরে নিয়ে টোল-চতুষ্পাঠী সংক্রান্ত পঠনপাঠনের সংস্কার বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করার উদ্দেশ্যে এই আলোচনা।

প্রস্তাবিত এই সংস্কারের প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত সংস্কৃত ভাষার অন্তর্গত বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণা-ক্ষেত্রের প্রসার, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন টোল ও পণ্ডিতমশাইদের বর্তমানের চরম দুর্দশা দূরীকরণ। সংস্কৃত ভাষার অন্তর্গত বিভিন্ন বিষয়ের পঠনের যে টোল ও চতুষ্পাঠী ব্যবস্থা ঐতিহাসিক ভাবে আমাদের দেশের ঐতিহ্যের মধ্যে মিশে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ইঙ্গ-সংস্কৃত পঠন ব্যবস্থার আওতায় তাকে পুরোপুরি এনে ফেললে ভারতীয় ঐতিহ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিককে আমরা হারিয়ে ফেলব। পশ্চিমবঙ্গেই এমন অনেক পরিবারের সদস্য আছেন, যাঁরা বংশ পরম্পরায় ইংরেজি শিক্ষা প্রভাবিত জ্ঞানভাণ্ডারের অন্য দিকগুলির চর্চা না করে মূলত সংস্কৃত ভাষার বলয়ে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার এবং অন্যান্য শাস্ত্র, দর্শন ইত্যাদির চর্চায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা নানান শাস্ত্র-দর্শন সম্পৃক্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার এই সব পরিবারের ব্যক্তিদের সংস্কৃতিরূপে, তাঁদের ভাবনা-চিন্তার শক্তিরূপে, তাঁদের আবেগময়তায় স্বপ্নের ঘোরের মতো জড়িয়ে আছে। বর্তমান দুর্দশার নিরিখে এই হতভাগ্য মানুষগুলোর প্রতি দৃকপাত না করলে আদতে আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়কেই অস্বীকার করব। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, সংস্কৃত ভাষায় রচিত ভক্তি-ধর্ম নিরপেক্ষ বহুবিধ শাস্ত্র-দর্শনের বিন্দুমাত্র খোঁজ না রেখে আজও বহু শিক্ষিত মানুষ সংস্কৃত ভাষা বলতেই বোঝেন সংস্কৃত ব্যাকরণের জ্ঞান— সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার বলতেই বোঝেন হিন্দু আচার-আচরণের উদ্বোধন। তাঁদের এ হেন অজ্ঞানতার সুবিধে গ্রহণ করে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সংস্কৃত ভাষার বিস্তীর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্য থেকে বেছে বেছে পুরাণ, ধর্ম ইত্যাদির বিশ্বাসনির্ভর বিষয়গুলি তুলে ধরেন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের থেকে প্রাচীন শাস্ত্রীয় বিজ্ঞান অনেক উন্নত ছিল, এই ধরনের আজগুবি কথা প্রচার করেন। এর ফলে এক দিকে সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে পঠিতব্য সুসাহিত্য, দর্শন ও অন্য বহু গবেষণার বিষয় অবহেলিত থেকে যায়, অন্য দিকে সংস্কৃত বিষয়ে অনভিজ্ঞ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে সংস্কৃত-বিরোধী মনোভাবের স্ফুরণ ঘটে।

টোল-চতুষ্পাঠীর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে টোল-চতুষ্পাঠীর শিক্ষাক্রমকে উপার্জনমুখী করে তোলার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বর্তমান যুগে উপার্জনের সূত্র ধরেই যুবক-যুবতীর ভবিষ্যৎ নির্ণীত হয়। অতীতের কত পেশা এই সূত্রেই এখন আর তেমন গ্রহণীয় পেশা বলে যথেষ্ট স্বীকৃত নয়। এ কথা মানতে হবেই, উপার্জনের মাপকাঠিতে ঐতিহাসিক টোল-চতুষ্পাঠীর পঠনপাঠনের ভবিষ্যতের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত ইঙ্গ-সংস্কৃত পঠনপাঠনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর। এর কারণ ইঙ্গ-সংস্কৃত পাঠ্যক্রমের শেষে অর্জিত বিএ, এমএ ডিগ্রির জোরে যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা যায়, যা টোল-চতুষ্পাঠীর উপাধিধারীদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয় না। টোল-চতুষ্পাঠীর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাক্রমে আদ্য, মধ্য ও উপাধি— এই তিনটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ‘তীর্থ’ প্রদান করা হয়। ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের এফ৪৬-১/৬৩ সংখ্যক বিবৃতি অনুসারে বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের মধ্য ও তীর্থ (অর্থাৎ উপাধি) পরীক্ষার মানকে যথাক্রমে ইন্টারমিডিয়েট (এখনকার বারো ক্লাস উত্তর হায়ার সেকেন্ডারির সমতুল) ও এমএ মানের সমতুল বলা হয়েছিল। আদ্য পরীক্ষা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। সেকেন্ডারি/হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পণ্ডিত নিয়োগের নিয়ম নির্ধারণের জন্যে কেন্দ্রীয় সংস্কৃত বোর্ডের সুপারিশ ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের ওই বিবৃতিটিতে উল্লিখিত হয়েছিল। কিন্তু তার বাইরে এর প্রয়োগ না থাকায় তীর্থ বা উপাধির জোরে এমএ মানের সমতুল বিবেচনায় বৃহত্তর ক্ষেত্রে টোল-চতুষ্পাঠীর ছাত্রছাত্রীদের অন্য কোনও নিয়োগের সুযোগ ছিল না। এর উপর পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৭৪ সালের সরকারি আদেশনামায় [সংখ্যা ৭৭২-এডুকেশন (এস) তারিখ ৮ জুলাই ১৯৭৪]ঘোষণা করে বিএ (পাস) ডিগ্রি ছাড়া স্বীকৃত হাই স্কুলে কোনও শিক্ষক নিয়োগ চলবে না, সম্ভবত যার পরিণামে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা অধিকারের গ্র্যান্ট-ইন-এড সেকশনের, সংখ্যা—৩২৭(১৬)জিএ/১-জি/৮ডি তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১-এর নির্দেশে বুঝিয়ে দেওয়া হয় বিএ ডিগ্রি ছাড়া শুধুমাত্র সংস্কৃত শিক্ষার ডিগ্রির জোরে স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষক নিয়োগ করলে তাঁদের আন্ডার-কোয়ালিফায়েড ধরা হবে। ফলে সংস্কৃত শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের জন্যে নির্দিষ্ট প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টোল-চতুষ্পাঠীর ছাত্রছাত্রীদের বসার সুযোগ রইল না।

(চলবে)

বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের ভূতপূর্ব সচিব

Sanskrit College Heritage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy