Advertisement
E-Paper

দেবী চরাচর সারে

আর এই ব্যাপারে আমাদের মতো আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তীব্র ঈর্ষা করতাম সেই বন্ধুদের যারা বাইরের ইস্কুলে পড়ত। কারণ তাদের বয়ান অনুযায়ী সরস্বতী পুজো আসলে বাৎসরিক এক প্রেম পার্বণ।

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৮

পুরুলিয়া জেলায় রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত যে বিদ্যালয়ে আমার কিশোরবেলা কেটেছে, সেখানে প্রকৃতি ছিল বড়ই সদয়। বর্ষা শেষে যেমন রেললাইন বরাবর চোখে পড়ত সাদা কাশের সারি, তেমনই শীত একটু পরিপক্ব হলেই বেড়া দেওয়া বাগানে ঝেঁকে আসত কুল। আমাদের মধ্যে যারা একটু বেশি দস্যি ছিল, তারা বেড়া ডিঙোত। বাকিরা তাদের সেই কীর্তিকলাপ দেখেও সাহস করে কুলের দিকে হাত বাড়াত না, কারণ হস্টেলের মহারাজ বলে দিয়েছেন সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে মা রাগ করেন। চিরকাল অঙ্কে কাঁচা আমি; মা কুপিত হলে কী দশা হতে পারে সে কথা ভেবে শিউরে উঠতাম। বছরের প্রথম কুলের স্বাদের মতো আরও অনেক কিছুই প্রথম বার হত সরস্বতী পুজোর দিন। বছরের সেই একটিমাত্র দিন যখন বইপত্রের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও শাস্তির ভয় ছিল না। খুব সকালে স্নান সেরে নিতে হত; গরম জলের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় অনেকটা সরষের তেল গায়ে ভাল করে রগড়ে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কয়েক মগ জল গায়ে ঢেলে নেওয়া। সকাল বেলার উপবাসটিও ছিল নতুন একটা ব্যাপার। দু’চার জন চিরকালের বিদ্রোহী অবশ্য সে নিয়মেরও অন্যথা করত। ধুতি পরে প্রার্থনাকক্ষে ঢুকে প্রতিমার পায়ের কাছে গিয়ে চট করে দেখে আসতাম সেখানে রাখা বইয়ের মধ্যে আমার কেশব নাগের অঙ্কবই আছে কি না। পুজো, আরতি, মাঝে মাঝে আমাদের সমবেত কণ্ঠে সঙ্গীত, শেষে অঞ্জলি। আমাদের ইস্কুলের প্রার্থনাগৃহে অভ্যাগত মহিলাদের আলাদা সারিতে বসার ব্যবস্থা ছিল। পুজোর আসরে গিয়ে বসা থেকে ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে’ বলা পর্যন্ত আমাদের চোখ নানা অজুহাতে মায়ের শ্রীমুখ থেকে একটু সরে ইতিউতি ঘুরে বেড়াত সেই সারিতে। চার চক্ষুর মিলন যে একেবারেই হত না, তা বলা যায় না। কিন্তু কঠোর অনুশাসনের নিগড়ে বাঁধা বিদ্যালয়ে সেই এক পলকের ভাললাগা ভালবাসাতে পরিণত হওয়ার সুযোগ পেত না।

আর এই ব্যাপারে আমাদের মতো আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তীব্র ঈর্ষা করতাম সেই বন্ধুদের যারা বাইরের ইস্কুলে পড়ত। কারণ তাদের বয়ান অনুযায়ী সরস্বতী পুজো আসলে বাৎসরিক এক প্রেম পার্বণ। সবাই মিলে পুজোর জন্য বাজার করা, অনেক রাত পর্যন্ত প্যান্ডেল সাজানো, ফল কাটা, ভোগ রান্নার তদারকি করা, প্রসাদ বিতরণ— তাদের ইস্কুলে এই সব কাজ ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে করে এবং বড় দাদা-দিদিরা এই সব কাজের মাঝেই কী রকম ভাবে যেন একটু নিরালা খুঁজে নেয়। ফলে প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর পর কয়েকটা ‘পেয়ারিং’ হয়ে যায়। এই সব গল্প শুনে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। দীর্ঘশ্বাস আরও প্রবল হত যখন শুনতাম পুজোর পরের দিন আমরা যখন প্রতিমা ‘বিসর্জন’ দিতে যাই, আমাদের বন্ধুরা যায় মা-কে ‘ভাসান’ দিতে। আমাদের মধ্যে কয়েক জন বাজখাঁই গলায় ‘জয় সরস্বতী মাই কি, আসছে বছর আবার হবে’ ইত্যাদি স্লোগান দিত আর আমরা গলা মেলাতাম। এই ছিল আমাদের বিসর্জনের উত্তেজনা। কিন্তু ট্রাক বা ম্যাটাডরে প্রতিমা চাপিয়ে মাইক বাজিয়ে গানের তালে নাচতে নাচতে দল বেঁধে ‘ভাসান’ দিতে যাওয়ার মজা যে আলাদা, সে আমরা খুব বুঝতাম। তবু অবুঝের মতো প্রশ্ন করতাম, ওদের শিক্ষকেরা কী ভাবে এ কাজে অনুমতি দেন। উত্তরে শুনতাম সরস্বতী পুজোতে অনেক কাজেই ছাড় পাওয়া যায়।

ছাড় যে সত্যিই পাওয়া যেত এবং তাতে শিক্ষকদের স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয় থাকত, সেটি বুঝেছিলাম কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে। পুজোর দিন সন্ধেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রথম বর্ষের শান্ত চোখের যে মেয়েটি নিখুঁত সুরে ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/ তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া’ গেয়েছে তাকে দেখে তৃতীয় বর্ষের ইংরেজি অনার্সের মেধাবী কিন্তু লাজুক ছাত্রটি যে নিজের সব ভুলেছে, সে কথা তার বন্ধুরা বুঝেছে আর বুঝেছেন তার চল্লিশোর্ধ্ব শিক্ষক। অনুষ্ঠান যখন মাঝপথে, তিনি হাতের ইশারায় সেই লাজুক ছেলেকে কাছে ডেকে দায়িত্ব দিলেন সুগায়িকাকে তার বাড়ির পথে কিছুটা এগিয়ে দিতে। সরস্বতী পুজোর দিনেই মেয়েরা অনুমতি পায় বয়স নির্বিশেষে শাড়ি পরার। খুলে যাওয়ার ভয়ে ক্লাস ফোরের বালিকা পাকা গিন্নির মতো আঁটোসাঁটো করে শাড়ি পরে আর সদ্য মাধ্যমিক পার করা ষোড়শী শাড়ি পরে যৌবনের উচ্ছলতায়। উভয়েরই মনে বড় হওয়ার সাধ; এক দিনের জন্য তা মেটান মা সরস্বতী। অনুমতি পাওয়া যায় খিচুড়ি ভোগ খাওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে এ দিক-ও দিক খানিক ঘুরে আসার। স্বাধীনতার এই স্বাদ কিছুটা হলেও পায় স্কুলের সেই মেয়েটিও যে রোজ স্কুলে আসার আগে মায়ের সঙ্গে দুটো বাড়িতে কাজ করে আসে। বাগ্‌দেবীর দয়াতে আজ সে সারা দিন ইস্কুলে, তার কাজের ছুটি।

সময়ের সঙ্গে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠান এবং আনন্দ আকারে ও প্রকারে অনেকটাই বদলেছে। স্কুলের পাশাপাশি এখন পাড়ার ক্লাব এবং বড় আবাসনগুলিতেও পুজো হয়। চাঁদা নিতে আসা ছেলেদের একটু কঠিন বানান বা ট্রানস্লেশন জিজ্ঞেস করে তার পর চাঁদা দেওয়ার সাহস এখন আর কেউ দেখান না। সন্ধেবেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বহু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন পেশাদার শিল্পীদের আনা হয়। ভাসানের আনন্দ উচ্ছৃঙ্খল চেহারা নিয়েছে ডিজে থেকে নির্গত শব্দদানবের দৌরাত্ম্যে। সর্বোপরি আমূল বদল এসেছে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা এবং ভালবাসার ব্যাকরণে। সম্মুখ সাক্ষাতের সুযোগ এবং স্বাধীনতা বেড়েছে বহু গুণ; আবার স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের দৌলতে চব্বিশ ঘণ্টাই ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। ফলে সরস্বতী পুজোর সেই স্বল্প স্বাধীনতাটুকুর প্রতীক্ষায় থাকা লাজুক তরুণ আর শান্ত কিশোরী আজ বিরল। এর সঙ্গে আবার অল্পবয়সিদের জন্য প্রেম দিবস হিসেবে এখন এসেছে কার্ড, চকোলেট এবং বিজ্ঞাপনের আলোকে উজ্জ্বল ভ্যালেন্টাইন্স ডে।

ইদানী‌ং আবার সরস্বতী পুজো ঘিরে কিছু নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক তর্জাও শোনা যায়। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল দাবি করে যে এই রাজ্যে মুসলিমদের দাপটে বিদ্যার দেবীর আরাধনা অনুষ্ঠান করা যায় না। আবার কট্টর মুসলমানেরা যুক্তি দেন যে বাগ্‌দেবীর পুজোতে মুসলিম ছেলেমেয়েদের অংশ গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ এই অনুষ্ঠান আদতে পুতুলপুজো। এই সব যুক্তি প্রতিযুক্তির কথা শুনলে আমার মনে পড়ে যায় বিদ্যালয় জীবনের বন্ধু শামিম আর গুরুদাসের কথা। সরস্বতী পুজো চলাকালীন শামিম ঋজু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে ধ্যানরত। নিতান্ত অধার্মিকের মতো তাকে উত্ত্যক্ত করে তার ধ্যান ভাঙাতে ব্যস্ত গুরুদাস। মনে পড়ে উত্তর কলকাতার এক অনামী সরকারি স্কুলের ছাত্রী কুলসুম খাতুনের কথা। অক্ষরপরিচয়হীন তার পিতামাতা তাকে সন্ধান দেন কংক্রিটের জঙ্গলে কোথায় দূর্বাঘাস খুঁজে পাওয়া যাবে। কুলসুমের তুলে আনা দূর্বাঘাস ছাড়া সেই বিদ্যালয়ে বিদ্যাদেবীর আরাধনা অসম্পূর্ণ।

আসলে দুর্গাপুজোর মতো ব্যাপ্ত না হলেও সরস্বতী পুজোর মধ্যে রয়েছে এক সহজ সর্বজনীনতা। কোজাগরী পূর্ণিমার আলোয় ভেসে বাঙালি যে লক্ষ্মীপুজো করে সে বড় আচারনির্ভর এবং সাধারণত পরিবারের চৌহদ্দির মধ্যেই তার সীমানা। কিন্তু বাঙালির বাগ্‌দেবীর আরাধনায় ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সমান ভাবে দৃশ্যমান সামাজিক মিলন। এই দিন যে শিশুর হাতেখড়ি হয়, তার জন্য থাকে আমাদের সবার শুভেচ্ছা। শীতের সকালে যখন কিশোরীর দল জীবনে প্রথম বার শাড়ি পরার আনন্দে উচ্ছল হয়ে দল বেঁধে হাজির হয় বিদ্যায়তনে, তাদের সেই আনন্দে জাতি ধর্মের মতো বিষয় কোনও দাগ ফেলতে পারে না; ছেলের দল সাধ্যের মধ্যে সুসজ্জিত হয়ে যখন অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়, সেই শিভালরিও হয়ে ওঠে একান্তই অকলুষ।

আর আমি? নিজের সন্তানের পরীক্ষার দিন তার স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশের মুহূর্তে উচ্চারণ করি: ‘বিসমিল্লাহি রহমানির রহিম।’ সেই মুহূর্তেই মনের ভেতরে কে যেন বলে ওঠে, “মা, ছেলেটাকে একটু দেখো। আমার মতোই অঙ্কে কাঁচা”।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

Saraswati Puja Universatility
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy