Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আদ্যন্ত জীবনটাই ছিল স্যাটায়ারে মোড়া

জীবনের নানা ওঠাপড়ায় টোল খায়নি তাঁর শ্লেষ আর উইট— এই অমোঘ দুই গুণ নিয়ে অচেনা দাদা ঠাকুরকে তাঁর জন্মদিনে (১৩ বৈশাখ) চিনিয়ে দিচ্ছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের নানা ওঠাপড়ায় টোল খায়নি তাঁর শ্লেষ আর উইট— এই অমোঘ দুই গুণ নিয়ে অচেনা দাদা ঠাকুরকে তাঁর জন্মদিনে (১৩ বৈশাখ) চিনিয়ে দিচ্ছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৪৮
Share: Save:

তিনি ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি। তাঁর পরিবারের অভাব ছিল, অনটন ছিল। কিন্তু কখনও কারও কাছ থেকে সামান্য দান গ্রহণ করেননি। এমনকি শিক্ষিত হয়েও চাকরির প্রতি তার সামান্য আকর্ষণ ছিল না। এ বিষয়ে কাকা রসিকলালের উপদেশ মেনে চলতেন। রসিকলাল ভাইপো দাদাঠাকুরকে বলতেন ‘It is better to starve than serve’. সুতরাং স্বাধীন কিছু করতে হবে এটাই ছিল দাদাঠাকুরের মানসিকতা। সকলকেই তিনি এই উপদেশ দিতেন। ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করাকে তিনি দাসত্ব বলে মনে করতেন।

এক সময় ‘বোতল পুরাণ’ ( একটি পুস্তিকা) কলকাতার রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন তিনি। রাস্তায় গাইতেন, ‘আমার বোতল নিবি কে রে?/ এই বোতলে নেশাখোরের নেশা যাবে ছেড়ে।’ হিন্দিতে গাইতেন, ‘ইস মে নেহি দারু/ খালি হ্যায় মিঠি ঝাড়ু/ পিকে শায়েস্তা হোগা শরাবী মাতাল।’ সাধারণ মানুষের অর্থলোলুপতাকে তিনি তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন তাঁর ‘টাকার ঊনপঞ্চাশ নাম’ ছড়ায়। সেখানে বলেছেন, ‘জয় টাকা জয় অর্থ রাজমূর্তি ধর/ রৌপ্যখণ্ড কর কৃপা সুখের সাগর।’ কবিতার শেষে বলেছেন –‘তুমি জ্ঞান, তুমি ধ্যান তুমি সারাৎসার/ তুমি বিনা দেখি প্রভু সব অন্ধকার।’ পরে লেকাটি ‘শতনামে’ বর্ধিত করেছিলেন। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের অনুকরণে লেখা এই কশাঘাত জর্জরিত কবিতাটিতে বাঙালির অর্থলোলুপতাকে নির্মম ভাবে আঘাত করেছেন তিনি। অন্য গানে বলেছেন, ‘দূরিত বিনাশিনী তঙ্কে/ রাজরাজেশ্বর মূর্তি বিভূষিতা/ রজতশুভ্র শুভ অঙ্কে।’ গানটি ‘পতিতপাবনী গঙ্গে’ নামক বিখ্যাত গানের সুরে গাওয়া হত।

দাদাঠাকুর বাল্যকালে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। পরবর্তী কালে স্ত্রীর ভালোবাসা, কন্যা, পুত্রবধূদের শ্রদ্ধা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। নারীর এই কল্যাণী মূর্তিকে তিনি পরম শ্রদ্ধা করতেন। সেই কারণে সমাজে নারীর যে কোনও রকম অসম্মানের বিরুদ্ধে তিনি খড়্গহস্ত ছিলেন। পণপ্রথার বিরুদ্ধে, শ্বশুরবাড়িতে বধূর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি একাধিক গান ও কবিতা রচনা করেছে। একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন— ‘আমাদের এই পোড়া দেশে আমাদের মেয়েদের পোড়া ছাড়া অন্য কোনও গতি নাই।’ নিজ কন্যার বিয়েতে পাত্রপক্ষ পণ চেয়েছিলেন বলে সেখানে তিনি কন্যার বিয়ে দেননি। অন্য দিকে নারীর অতি আধুনিকতা, স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন। বলেছেন –‘বুক ফাটেতো মুখ ফোটে না স্বভাব ছিল আগে/ এখন কথায় ফুটছে খৈ তুবড়ী কোথা লাগে।’ পরে বলেছেন –‘ আজকে ডিনার কাল টিপার্টি পরশু প্রীতিভোজ/ থিয়েটার ও বায়োস্কোপে এনগেজমেন্ট রোজ/ স্বামী যদি সঙ্গে চলে অবজেকশান তাতে/ বলে বাসায় কে থাকবে? আসবো না আজ রাতে।’

তিনি আচার আচরণে যেমন ছিলেন অকৃত্রিম বাঙালি, তেমনই তাঁর রচনার অন্যতম প্রসাদগুণ হল প্রচলিত মাতৃভাষাকে অবিকল ব্যবহার করা। অকারণ তৎসম শব্দ ব্যবহার তিনি পছন্দ করতেন না। আবার প্রচলিত আরবি, ফারসি, ইংরেজি শব্দ অনায়াসে ব্যবহার করেছেন। বাঙালির লোকায়ত জীবনে প্রচলিত বাক্‌ধারা, প্রবচন অবিকল ব্যবহার করেছেন তিনি। বাঙালী বাবুদের অকারণ ইংরেজিয়ানাকে তিনি তীক্ষ্ণ ভাবে আক্রমণ করেছেন। একটি গানে বলেছেন, ‘বাজিয়ে বীণা নতুন তানে/ বর্দ্ধমান আজ বার্ডোয়ানে/ চুঁচুড়ার অদৃষ্টে ছিল চিনসুরার সুরাতে ভাসা/ ভেবেছিল কেউ কি কবে/ মেদিনীপুর মিডনাপো হবে/ কাঁথির মাথায় লাথি মেরে কন্টাই-এ করবে কোণঠাসা। বাংলা ভাষার এই বিকৃতি তিনি মেনে নিতে পারেননি কোনও ভাবেই।

বাংলা কবিতায় প্যালিন্ড্রম রচনায় তাঁর প্রতিভা তর্কাতীত। একটি পঙক্তির বাম দিকে থেকে এবং ডান দিক থেকে পড়লে একই শব্দ গঠিত হওয়াকে ইংরেজিতে প্যালিণ্ড্রম বলে। দাদাঠাকুরের রচনায় দেখা যায় – ‘রাধা নাচে অচেনা ধারা/ রাজন্যগণ তরঙ্গরত নগন্য জরা/ কীলক সঙ্গ নয়নঙ্গ সকল কী?/ কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী’। এই পঙক্তিগুলি বামাবর্ত এবং দক্ষিণাবর্তে একই পাঠ হয়। রচনাগুলি অনেকটা মহাভারতের ‘ব্যাসকূট’-এর মত। আপাত ভাবে নিরর্থক মনে হলেও এ গুলির গভীর অর্থ থাকে। উপরের কবিতাটির অর্থ হল, ‘রাধা নবপ্রেমের আনন্দে বেতাল ভঙ্গিতে নৃত্যরত। বৃদ্ধরা নিজেদের জরাকে উপেক্ষা করে নিন্দা করতে ব্যস্ত। রাধা সেটা শুনে কটাক্ষপাত করছে। এটা বর্ণনা করে কীর্তনগায়িকা পঞ্চমতালে নৃত্য করছে’। অন্য একটি প্যালিনড্রম হল—‘থাক রবি কবির কথা/ বিরহে রাধা নয়ন ধারা হেরবি।’ এর অর্থ হল, ‘রবীন্দ্রনাথ কবির কথা এখন থাক। এখন বিরহে রাধার চোখ দিয়ে জল ঝরছে তাই শুধু দেখা যাচ্ছে।’

ঈশ্বরের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল না, আবার নাস্তিক ছিলেন বলে মনে হয় না। পরন্তু তিনি ঈশ্বরকে কোথাও কোথাও ব্যঙ্গ করেছেন।

ঈশ্বর গুপ্ত যেমন বলেছিলেন (ঈশ্বর সম্বন্ধে) ‘তুমি হে আমার বাবা হাবা আত্মারাম’। তিনিও তেমনি বলেছিলেন –‘সাবধান হয়ে আসিস মা তারা/ লক্ষ্মীছাড়ার দেশে এ বার গো/ আসতে হবে লক্ষ্মীছাড়া।’

এই গানের শেষে বলেছেন, ‘নিতে এসে পূজা দশভূজা মা পরবি দশ হাতে পাঁচ হাতকড়া’। অন্য গানেও তিনি ঈশ্বরকে বিভিন্ন ভাবে ব্যঙ্গ করেছেন। এক বার তাঁর ব্রাহ্মণী (স্ত্রী) সন্তানের আরোগ্য কামনায় জগজ্জননীর কাছে মানত করেছিলেন। সেটা জানতে পেরে দাদাঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, ‘যে তার নিজের ছেলের শুঁড় (গণেশের) ভাল করতে পারে না, সে তোমার ছেলের রোগ ভাল করতে পারবে’।

তাঁর দারিদ্র্য ছিল তাঁর অলঙ্কারের মত। নজরুলের মতো তিনিও অনায়াসে বলতে পারতেন ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’। তিনি ধনী ব্যক্তিদেরকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু মহৎ মানুষদের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্য ছিল অকৃত্রিম। নজরুল ইসলামকে তিনি ভ্রাতৃস্নেহে তুই সম্বোধন করতেন।

বাংলা গানে ও কবিতায় তিনি যে স্যাটায়ারের চর্চা করেছেন তা আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। প্রাত্যহিক কথাবার্তায় উইটের ব্যবহারে বাঙালী সমাজ তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। বিশেষত শ্লেষ ও যমক অলঙ্কারের অসাধারণ ব্যবহার তাঁর বিভিন্ন কথাবার্তায় দেখা যায়। বাংলার লোকায়ত জীবনে চলিত ছড়া, গান, পাঁচালীর সঙ্গে শিষ্ট সমাজের সাহিত্যের মেলবন্ধন করেছিলেন তিনি। তাতে তিনি সার্থক। দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কে তিনি গানের সুরে পরিবেশন করে অত্যন্ত রসগ্রাহী করে তুলেছেন। ‘ইঁটের টুকরোকে তিনি প্রতিভাবলে মার্বেল পাথরে পরিণত করেছেন’। তাঁর কোনও কোনও কবিতা বা গানের কলি বাঙালির জীবনে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বাক্‌বিধি আমরা অনেক সময় ব্যবহার করি। যে বাক্‌বিধি দ্ব্যর্থবোধে গৌরবার্থক ও রসগ্রাহী।

কবি ঈশ্বর গুপ্তের যথার্থ উত্তরসুরি ছিলেন তিনি। দাদাঠাকুরও ছিলেন যে কোনও রকম ‘মেকি’র শত্রু। গুপ্তকবির মত তিনি ছিলেন আপাদমাথা বাঙালি কবি। জঙ্গিপুর থেকে কলকাতা, সেখান থেকে দিল্লি; সমসাময়িক অসংখ্য গুণিজনের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি, কিন্তু খালি গা, নগ্ন পদে সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে কোনও সময় যে কোনও পরিস্থিতিতে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিতে কবিতা রচনা করতে পারতেন। সুর দিয়ে সুরেলা গলায় গান গাইতেও পারতেন। পৃথিবীব্যাপী চলচিত্র শিল্পে ‘বায়োপিক’ বা জীবন নির্ভর চলচিত্র নির্মাণের একটি বলিষ্ঠ ধারা এখন পুষ্ট হয়েছে। দাদাঠাকুরের জীবদ্দশাতেই তাঁর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে। অসাধারণ জনপ্রিয় সেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন শ্রদ্ধেয় ছবি বিশ্বাস, গান গেয়েছিলেন বাংলা গানের জগতে কিংবদন্তি গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পরে দাদাঠাকুর সরস ভঙ্গিতে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে বলেছিলেন—‘ ছবি, তুমি আমাকে জীবন্ত অবস্থায় ছবি বানিয়ে দিলে!’ স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা হয়েছিল – ‘Interestingly, that remarkable man, Sarat Pandit, who is the original of the film, Dada Thakur, is still around us. এই কাগজেই চলচিত্র এবং দাদাঠাকুরের জীবনের ভূয়ষী প্রশংসা করা হয়। প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র দাদাঠাকুরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি একসময় বলেছিলেন, ‘গল্প উপন্যাসের চেয়েও চিত্তাকর্ষক দাদাঠাকুরের জীবনী।’

কলেজ শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

দাদাঠাকুর Dada Thakur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE