Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিপন্ন উড়াল

এই বৎসরের বুকার পুরস্কার-প্রাপ্তির বক্তৃতায় মার্কিন লেখক জর্জ সন্ডার্স বলিয়াছেন, আমাদের এই ‘উদ্ভট সময়’-এর কেন্দ্রে নিহিত একটি সরল প্রশ্ন: আমরা কি ভয় পাইলে তাহার মোকাবিলা করিব বর্জন, প্রত্যাখ্যান, নেতিবাচক আরোপ এবং হিংসা দিয়া, না কি বিশ্বাসের উড়ালে সওয়ার হইয়া প্রাণপণ চেষ্টা করিব ভালবাসা দিয়া সমাধান করিতে?

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:২২
Share: Save:

কা নপুরে পুলিশ দুই ব্যক্তিকে ধরিল এমন বেলুন বিক্রয় করিবার জন্য, যাহাতে লিখা ‘আই লাভ পাকিস্তান’। তদন্তে দেখা যাইল, একটি বস্তায় সহস্র বেলুনের মধ্যে মাত্র তিনটি বা চারিটিতে এমন কথা লিখা, তাহাও এমন প্রক্রিয়ায়, বেলুনগুলি না ফুলাইলে বুঝিবার উপায় নাই আদৌ কিছু লিখিত। যে খুচরা বিক্রেতা বেলুনগুলি বিক্রয় করিতেছিলেন এবং যে পাইকারি বিক্রেতা তাঁহাকে ওইগুলি বিক্রয় করিয়াছিলেন, উভয়েরই পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড হইতে পারে, যদি তাঁহারা জাতীয় সংহতি বিপন্ন করিবার অভিযোগে আদালতের দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হন। নালিশ যিনি করিয়াছেন, তিনি ‘হিন্দু যুব বাহিনী’র সহিত জড়িত, যাহা এক দশক পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেন যোগী আদিত্যনাথ, এবং যে বাহিনী কিছু দিন পূর্বে তাজ মহল চত্বরে শিবস্তোত্র পাঠ করে। সব কিছুই যেন সরল চিত্রনাট্য মানিয়া চলিতেছে। কে এমন বেলুন প্রস্তুত করিল, সেই প্রশ্নের পূর্বে যে প্রশ্নটি করা প্রয়োজন: যদি বেলুনে ‘আমি পাকিস্তানকে ভালবাসি’ লিখা থাকে, ক্ষতি কী? কেন ভারতের লোক বেলুন উড়াইয়া বলিতে পারিবে না, সে বা তাহারা একটি প্রতিবেশী দেশকে ভালবাসে? গড় ভারতীয় বলিতেই পারেন, যে-দেশ ভারতের সৈন্যদের উপর হামলা করিতেছে এবং উগ্রপন্থাকে লালন করিতেছে ভারতকে বিপন্ন করিবার জন্য, সে দেশকে ভালবাসিবার কথা উঠিতেছে কোথা হইতে। উত্তর, উক্ত কাজগুলি পাকিস্তানের একমাত্র পরিচয় নহে। রাজনৈতিক বৈরিতাকে অতিক্রম করিয়া একটি দেশের সাধারণ মানুষকে, সাংস্কৃতিক সম্পদ, খাদ্য, সামাজিক পরম্পরাকে ভালবাসা যাইতে পারে। আর যদি পাকিস্তান ভারতের শত্রুও হয়, বিদ্বিষ্ট দেশের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের ক্ষমতা মানুষকে উদার ও অধিক পরিণত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিবে।

এই বৎসরের বুকার পুরস্কার-প্রাপ্তির বক্তৃতায় মার্কিন লেখক জর্জ সন্ডার্স বলিয়াছেন, আমাদের এই ‘উদ্ভট সময়’-এর কেন্দ্রে নিহিত একটি সরল প্রশ্ন: আমরা কি ভয় পাইলে তাহার মোকাবিলা করিব বর্জন, প্রত্যাখ্যান, নেতিবাচক আরোপ এবং হিংসা দিয়া, না কি বিশ্বাসের উড়ালে সওয়ার হইয়া প্রাণপণ চেষ্টা করিব ভালবাসা দিয়া সমাধান করিতে? সমগ্র পৃথিবীই যেন সন্ডার্সের এই প্রশ্নের উত্তরে হিংসা বাছিয়া লইতে তৎপর। বিদেশি যুগলকে মারিয়া ধরিয়া পথে ফেলিয়া দিতেছে এক দল লোক, আপাত ভাবে কোনও রূপ প্ররোচনা ছাড়াই। কেবল ওই যুগল অন্য রূপ দেখিতে বলিয়াই কি এই পরিমাণ ঘৃণা জন্মাইয়া গেল? অন্য পাড়ার লোক এই পাড়ায় ঘুরঘুর করিতেছে দেখিয়াই কি তাহাকে বাঁধিয়া পেরেক-সম্পন্ন কাঠের টুকরা দিয়া মারিতে মারিতে খুন করিয়া ফেলিবার যৌক্তিকতা অনেকগুলি মানুষের হৃদয়ে ঢুকিয়া পড়ে? চিকিৎসক এক প্রসূতিকে অন্য হাসাপাতালে রেফার করিলে তাহার প্রতিবাদে কিছু হামলাকারী শৌচাগারে লইয়া গিয়া তাঁহার গাত্রে বিষ্ঠা মাখাইয়া দিবে? দুই মহিলা আবাসনের ভিতর কয়েকটি কুকুর আনিয়া তাহাদের দেখভাল করিলে আবাসনের কুড়ি জন লোক মিলিয়া তাঁহাদের পিটাইবে ও জামাকাপড় ছিঁড়িয়া দিবে? কেরলের যে হিন্দু প্রাপ্তবয়স্কা নারী এক মুসলিমকে বিবাহ করিয়াছেন, এবং আদালতের নির্দেশে বাপের বাড়িতে ফিরিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাঁহাকে ভিডিয়োতে অসহায় ভাবে বলিতে হইবে: আমাকে সাহায্য করুন, নচেৎ আমি দুই দিনের মধ্যে খুন হইব, আমার বাবা রাগিয়া উঠিতেছেন? মানুষের আবহটি হইয়া উঠিতেছে অবিশ্বাসের, আতঙ্কের, ঘৃণার। এই পরিবেশ গড়িবার পিছনে রাষ্ট্রের দায় অবশ্যই আছে, সে ধর্মীয় আগ্রাসন দিয়াছে ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারে নাই; কৃষকের আত্মহত্যা, যুবসমাজের বেকারত্ব, নিত্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি সার্বিক বিপন্নতা বাড়াইতেছে, কিন্তু তাহাই কি হিংস্রতার ব্যাখ্যাটিকে সম্পূর্ণ করে? তবে কি সর্বব্যাপী পুঁজিবাদ ও লোভের (অনন্ত আকাঙ্ক্ষা কখনও না মিটিবার, অন্য ভোক্তার প্রতি ঈর্ষা-জর্জর হইবার) বন্দোবস্তই সার্বিক ক্ষোভের বায়ু সৃষ্টি করিল? উত্তর জটিল ও অজানা। ইহার মধ্যে অ্যাশেজ সিরিজের পূর্বে অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড় ডেভিড ওয়ার্নার বলিয়া দিলেন, তিনি হৃদয় খুঁড়িয়া ঘৃণা বাহির করিতেছেন (ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের প্রতি), কারণ এ এক যুদ্ধ। ভাগ্যক্রমে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড বলিয়াছেন, তিনি ঘৃণার অনুশীলন করিবেন না, ইহা যুদ্ধ নহে, নিছক খেলা মাত্র। আশা করা যায়, ভারতেও, ‘ব্রড-মানসিকতা’র মানুষেরা, খেলার বেলুনে কী লিখা রহিয়াছে তাহা লইয়া তপ্ত বায়ুর চাষ করিবেন না।

যৎকিঞ্চিৎ

বিজ্ঞানীরা বললেন, বুড়ো মানুষদের শরীর ভাল রাখতে, দাঁড়ানো, হাঁটা বড্ড জরুরি। তাই লিফ্ট থাকলেও তাঁদের বলুন, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে। সিনিয়র সিটিজেনের সিটে তাঁরা বসতে চাইলে, বলুন, দাঁড়িয়ে থাকাই তাঁদের পক্ষে মঙ্গলজনক। ওঃ, যুবসমাজ লাফিয়ে বিজ্ঞানীদের জড়িয়ে ধরবে! চার পাশ দেখে মনে হয়, তরুণদের স্বপ্ন: মেট্রোয় বা বাসে মহানন্দে ছড়িয়ে বসে আড্ডা ও মোবাইল-গেম বাগাব, সিট-প্রত্যাশী বুড়োদের আড়ে টিটকিরি মারব। এত দিনে অভদ্রতা বিজ্ঞানসম্মত হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kanpur I Love Pakistan Balloon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE