Advertisement
E-Paper

আসিফা ও শঙ্করাচার্য

জম্মু-কাশ্মীরের শীত অবশ্য ব্রহ্ম মানে না। সন্ন্যাসী ও তাঁর সঙ্গীরা শ্রীনগরের পাহাড়ি পথে সবে পা বাড়িয়েছেন, হুহু ঠান্ডা হাওয়া।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ০০:০৯

সন্ন্যাসী ও তাঁর শিষ্যরা আগে কখনও হিমালয় দেখেননি। দেখার কথাও নয়! ওঁরা আসছেন কেরল, বারাণসী, নর্মদাতীরের ওঙ্কারেশ্বর ইত্যাদি জায়গা থেকে। তুষারশৃঙ্গ সেখানে নেই। এই সন্ন্যাসী ব্রহ্মবিদ দার্শনিক। তাঁর ধারণা, জগতে আমি, আমার নাম, আমার বাবা, আমার মা, আমার স্ত্রী-সংসার-সম্পত্তি সবই রজ্জুতে সর্পভ্রম। মানে, রাতের বেলায় একগাছি দড়ি দেখে ‘সাপ সাপ’ বলে ভয় পেয়ে ছুটছি। দৃষ্টিবিভ্রম কাটলে বোঝা যাবে, ভয়ের কিছু নেই। আমি তথা আমার বাবা-মা-বৌ-বাড়িঘর-সংসার সবই বিভ্রম। আমিই তো ব্রহ্মাত্মা! এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ব্রহ্ম, আমার মধ্যেও তাঁরই প্রকাশ। স্রেফ মায়ার অন্ধকার জালে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছে বলে এত ‘আমার আমার’ চিৎকার।

জম্মু-কাশ্মীরের শীত অবশ্য ব্রহ্ম মানে না। সন্ন্যাসী ও তাঁর সঙ্গীরা শ্রীনগরের পাহাড়ি পথে সবে পা বাড়িয়েছেন, হুহু ঠান্ডা হাওয়া। এমনিতেই ক্লান্তিতে হাত-পা অবশ, ক্ষুধায় প্রত্যেকে অবসন্ন। আগুন জ্বেলে শীত নিবারণের প্রয়াস বিফল, এই হিমেল রাতে শত চেষ্টাতেও আগুন জ্বলছে না। রাতটা না খেয়ে, ঠান্ডাতেই কাটিয়ে দিতে হবে।

এই সময়েই পাকদণ্ডী বেয়ে স্থানীয় এক বালিকা হাজির হল ব্রহ্মবিদ সন্ন্যাসীদের কাছে। ব্রাহ্মণ-টাহ্মন নয়, এখানকার মেষপালকদের মেয়ে। দুটো কাঠ এনে, হাওয়া থেকে আড়াল করে বেশ কিছু ক্ষণ ঘষল সে। ছিটকে বেরোল আগুনের স্ফুলিঙ্গ। দরিদ্র মেষপালক-কন্যা হেসে সন্ন্যাসীকে জানাল, ‘‘হে ব্রহ্মবিদ শঙ্করাচার্য, ওই কাঠটি নির্গুণ ব্রহ্ম। আর তার মধ্যে যে স্ফুলিঙ্গ ছিল, সেটিই শক্তি। শক্তি না থাকলে তোমার ওই ব্রহ্ম প্রকাশিত হয় না।’’ তার পরই সহসা অন্তর্হিত হল সে।

আদি শঙ্করাচার্যের জীবন নিয়ে অনেক গালগল্প, উপকথার মধ্যে এটি অন্যতম। বিধবা মা বালক পুত্রকে সন্ন্যাসের অনুমতি দিচ্ছেন না, নদীতে কুমির সেই বালকের পা টেনে ধরল। বালক চেঁচিয়ে বলল, ‘‘মা, সন্ন্যাসের অনুমতি না দিলে আজ মৃত্যু। কুমির এখনই আমাকে জলের নীচে টেনে নিয়ে যাবে।’’ কিংবা বারাণসীর গঙ্গার ধারে তরুণ সন্ন্যাসী এক চণ্ডালকে বললেন, ‘হঠো।’ চণ্ডাল বলল, ‘‘সবাই তো শিব। তবু এত ঘৃণা?’’ তরুণ শঙ্করাচার্য দিব্যদৃষ্টিতে বুঝলেন, কাশীতে স্বয়ং শিব তাঁকে চণ্ডাল বেশে দর্শন দিলেন। দরিদ্র মেষপালক-কন্যার এই গল্পটিও সে রকম কয়েকশো বছর ধরে চলে-আসা এক মিথ।

কিন্তু হিন্দু ধর্মকে বুঝতে হলে এই মিথগুলিকে নিছক গালগপ্পো বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর একটু ভিতরে ঢুকতে হবে। বুঝতে হবে, স্বয়ং মহামায়াই দরিদ্র মেষপালক-কন্যার বেশে এসে ব্রহ্মবিশারদ সন্ন্যাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেলেন। জনশ্রুতির দ্বিতীয় অধ্যায়, এর পর কাশ্মীরেই শঙ্কর শক্তিরূপিণী মহামায়ার স্তব ‘সৌন্দর্যলহরী’ রচনা করেন। সেখানেই ৫৫ নম্বর শ্লোকে তিনি জানান, ‘‘হে পর্বতদুহিতা, তোমার চোখের পাতার ওঠাপড়াতেই এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়। বিশ্বকে স্থিতিশীল রাখতেই তুমি দু’চোখ মেলে সব সময় তাকিয়ে থাকো।’’

এই শ্লোকগুলি আদতে শঙ্করাচার্যের লেখা কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে তর্ক আছে। কিন্তু, পণ্ডিতি তর্ক থাকুক, গল্পগুলিই তো আমরা খেয়াল রাখিনি। না হলে দরিদ্র মেষপালক-বালিকা আসিফার ধর্ষণ ও হত্যা মামলা সুপ্রিম কোর্টকে জম্মু থেকে পঠানকোটের আদালতে পাঠাতে হয়? উপকথায় মহামায়া কাশ্মীরের মেষপালক-বালিকার বেশে বৈদান্তিক শঙ্করাচার্যকে দেখা দেন, আর আজকের বাস্তবে অভিযুক্তকে বাঁচাতে, বিজেপির দুই মন্ত্রীকে নিয়ে ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’ মিছিল করে, আসিফার পরিবার ও আইনজীবীকে ভয় দেখায়! সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি পঠানকোটে পাঠানোর সময় তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছে, ‘‘ভয় আর ন্যায়বিচার অর্থবহ ভাবেই বিপ্রতীপ।’’ আসিফা গুজ্জর বা বকরওয়াল জনজাতির মেয়ে। ঘটনার পর ভয় দেখাতে কাঠুয়ার দুটো গুজ্জর গ্রামে জলের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল। তাকে গ্রামের সমাধিস্থলে না নিয়ে গিয়ে অন্য গ্রামে শেষ সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছিল তার পরিবার। এই হিন্দুরা কারা, যারা মহামায়ার জীবন্ত রূপকে ভয় দেখায়, ধর্ষণের পর খুন করে, তার পর সমস্ত ভুলে নবরাত্রি আর দীপাবলিতে ফের শক্তি-উপাসনার ঢং করে?

আইন আইনের পথে চলবে, জম্মুতে বা যমুনানগরে সর্বত্র নাবালিকা ধর্ষণ সমান অপরাধ। কিন্তু একতা মঞ্চ-টঞ্চ তৈরির সময় হিন্দুত্ববাদীদের খেয়াল রাখা উচিত ছিল, হিন্দুধর্মে স্থানমাহাত্ম্য বলে একটা কথা আছে। কুম্ভমেলা বা কেদারনাথের পথে মারা গেলেও তাই অক্ষয় স্বর্গবাস! এই ভয় দেখানো একতা মঞ্চটি কোথাকার হিন্দু, যারা মন্দিরের স্থানমাহাত্ম্যেও বিশ্বাস রাখে না?

আসিফার মর্মান্তিক ঘটনা এবং তার পর সকলের উত্তাল প্রতিবাদ ঠারেঠোরে একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছে। শঙ্করাচার্যের তপোভূমিতে ধর্ষণকারীদের আড়াল করতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদীদের হাতে হিন্দু ধর্ম কতটা বিপন্ন! মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতা বলেছিলেন, ‘‘এগুলি পাকিস্তানের চক্রান্ত।’’ আর কত দিন কথায় কথায় উপত্যকায় পাকিস্তান আর মুসলমানের জুজু দেখানো চলবে? তার চেয়ে হিন্দুত্ববাদীরা বরং কাশ্মীরে শঙ্করাচার্য নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করুন। দেখবেন, শ্রীনগরের পাহাড়ে শঙ্করাচার্যের মন্দিরটি সংস্কার করে দিয়েছিলেন জয়েন-উল-আবিদিন বা শেখ মইনুদ্দিনের মতো মুসলমান শাসকেরা।

আসিফার কথায় শঙ্করাচার্যকে দেখা দেওয়া সেই রহস্যময় কাশ্মীরি বালিকা এবং ‘সৌন্দর্যলহরী’র শক্তিস্তোত্র আসবেই। এ দেশের জনপ্রিয় মিথ, বৈদান্তিক শঙ্কর পুরী, দ্বারকা, শৃঙ্গেরী ও জোশীমঠ— ভারতের চার কোণে চারটি মঠ তৈরি করেছিলেন। যিনি মাত্র ৩২ বছর বাঁচলেন, তিনি চার দিকে এমন চারটি মঠ কী ভাবে তৈরি করলেন? বিতর্ক আছে। কিন্তু একটি বিষয়ে কোনও বিতর্ক নেই। বৈদান্তিক শঙ্করের নামাঙ্কিত চার মঠেই রয়েছেন চার শক্তি। পুরীর গোবর্ধনমঠে উপাস্য পুরুষোত্তম জগন্নাথ, তাঁর শক্তি বিমলা। শৃঙ্গেরী মঠে শক্তি হিসেবে রয়েছেন শারদা। দ্বারকায় আছেন সিদ্ধেশ্বর, তাঁর শক্তির নাম ভদ্রকালী। জোশীমঠ বা জ্যোতির্মঠে উপাস্য নারায়ণ। তাঁর শক্তি পূর্ণগিরি। কাশ্মীরের সেই মেঘবালিকা না থাকলে এই চার মঠে শক্তি উপাসনা হত কি?

জম্মু-কাশ্মীরে শঙ্করাচার্য ও তাঁর শক্তি-উপাসনা নিয়ে মিথ যে কত! শক্তি উপাসনা নিয়ে এক কাশ্মীরি নারীর সঙ্গে তর্কে প্রবুদ্ধ সন্ন্যাসী, টানা ১৭ দিন ধরে চলল শাস্ত্র আলোচনা। পরিশেষে সন্ন্যাসীর পরাজয়। শঙ্কর যাকে নির্গুণ ব্রহ্ম দেখছেন, কাশ্মীরি অদ্বৈতবাদ তাকেই দেখছে নির্গুণ শিব হিসেবে। সেই শিবই তো শক্তির প্রকাশে সগুণ।

আকাট অশিক্ষিত, নির্বোধ, মূঢ় হিন্দুত্ববাদ খেয়াল রাখেনি, মেষপালক গুজ্জর বালিকায় সেই শক্তিরই প্রকাশ দেখেছিলেন হিন্দু সন্ন্যাসী!

Asifa Bano Shankaracharya Hinduism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy