ফাইল চিত্র।
অদ্ভুত প্যাঁচ আর আজব পয়জারে আটকে পড়েছি আমরা সকলে মিলে। জট আর কাটে না কিছুতেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ যেন মরীচিকা এক। ওই সামনেই ভোটগ্রহণের তারিখ দেখা যায়। কাছে আসতেই যেন আবার সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
ভোট কবে? রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ১৪ মে-তেই হবে ভোট? নাকি হাইকোর্টের নির্দেশে পিছিয়ে যাবে আবার, তারিখ ঘোষিত হবে নতুন করে? সব প্রশ্নের জবাব মিলতে পারে আজ। সাগ্রহে তাকিয়ে গোটা বাংলা। কিন্তু বাংলা যে শুধু কোনও একটা রায় বা ভোটগ্রহণের কোনও একটা তারিখের অপেক্ষায় রয়েছে, এমনটা ভাবলে বেশ ভুল হবে। বাংলা কিন্তু আসলে যথাযথ বিহিতের অপেক্ষায় রয়েছে।
নবম পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছে বাংলা। অর্থাৎ এর আগে আরও আট বার পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে গিয়েছে এ রাজ্যে। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে যে পরিস্থিতি এ বার দেখা যাচ্ছে, তেমনটা আগে কখনও হয়নি।
বেনজির এই পরিস্থিতির দায় কার? হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। না হলে প্রশাসনের। এর বাইরে কোনও পক্ষকে দায়ী করা সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়। শাসক দল হোক বা বিরোধী, সব পক্ষই নির্বাচনের অংশগ্রহণকারী, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রক নয়। নিয়ন্ত্রক হল কমিশন এবং তার সহযোগী রাজ্য প্রশাসন। পরিস্থিতি যদি আজ নিয়ন্ত্রণে না থাকে, বেনজির জটিলতা এবং টানাপড়েন যদি তৈরি হয় নির্বাচনকে ঘিরে, জট কাটানোর জন্য বিভিন্ন পক্ষকে যদি বার বার আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়, তা হলে নিয়ন্ত্রকদের অক্ষমতাই যে প্রকট হয়, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
অকারণে আটকে যায়নি পঞ্চায়েত নির্বাচন। ভোট প্রক্রিয়াকে ঘিরে অজস্র অনিয়ম-বেনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মূল অভিযোগ সন্ত্রাসের এবং অভিযোগের আঙুল শাসক দলের দিকে। বিরোধীদের তরফ থেকে অভিযোগ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তারও, প্রশাসনিক অসহযোগিতারও। অভিযোগ খোদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও। সে অভিযোগ পক্ষপাতিত্বের, সে অভিযোগ প্রতিটি পদক্ষেপে শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনে কাজ করার। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা করার কথা, সেই প্রতিষ্ঠানই যদি অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলির অধিকাংশের আস্থা হারিয়ে ফেলে, তা হলে এমন অচলাবস্থা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। আস্থাটা যে ধরে রাখা জরুরি, নির্বাচন আর ‘যাচ্ছেতাই’ যে সমার্থক হতে পারে না, সে কথা রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মনে রেখেছিলেন কি না জানা যায় না।
ভারতে অবশ্য গণতন্ত্রের মাটিটা যথেষ্ট পরিপক্ক। যে গণতান্ত্রিক কাঠামো ভারতে রয়েছে এবং দীর্ঘ সাংবিধানিক অনুশীলনের মাধ্যমে সে কাঠামোকে ভারত যে রকম নিষ্ঠার সঙ্গে বলবত্ রেখেছে, তাতে গণতন্ত্রের নামে ‘যাচ্ছেতাই’ চালানো অত সহজ নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রে বন্দোবস্ত এমনই যে, কোনও একটি স্তম্ভে অনিয়ম-বেনিয়ম দেখা দিলে অন্য স্তম্ভে গিয়ে আটকে যায়। রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরেও সেই ঘটনাই ঘটল। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ফলশ্রুতিতে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া আদালতে আটকে গেল। ব্যবস্থাপনায় রন্ধ্র যদি না থাকত, এ ভাবে আটকে যেত না নির্বাচন। ভোটের ভবিষ্যত্ কী, জট খুলবে কোন পথে, এখনও স্পষ্ট নয়। আদালতই সমাধানের পথ খুঁজে দেবে, নাকি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানে পৌঁছনোর ভার ফের কমিশনকেই দেবে আদালত, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া বাকি। কিন্তু, যথেচ্ছ অনিয়ম-বেনিয়ম যে এ গণতন্ত্র বরদাস্ত করে না, তা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
শিক্ষা রাজনীতিকদেরও নিতে হবে। এ দেশের ইতিহাস সাক্ষী, গণতন্ত্রের উপরে স্বেচ্ছাচারী কোনও আঘাত কখনও জয়ী হয়নি। জরুরি অবস্থার ফল ভুগতে হয়েছিল ইন্দিরা গাঁধীকে। বিপুল ব্যয়ের ‘ইন্ডিয়া সাইনিং’ প্রচার কর্মসূচির উপরে অতিরিক্ত ভরসা রাখার ফল ভুগতে হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারকে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাই এবং আরও অনেক অনাকাঙ্খিত রক্তপাতের জবাব বামেদের পেতে হয়েছিল। এ দেশের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের প্রবল চেষ্টার পরেও এই জবাবগুলোকে ঠেকিয়ে রাখা যায়না। ঠেকিয়ে রাখা যায় না কারণ এ দেশের মানুষ চূড়ান্ত রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারকে কখনও মেনে নেন না। এ সত্য যাঁরা উপলব্ধি করেননি, তাঁদের বড় মাশুল গুনতে হবে অচিরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy