—ফাইল চিত্র।
তখনও করোনাভাইরাস ভবিষ্যতের গর্ভে। ভারতীয় অর্থনীতির গতিভঙ্গের লক্ষণগুলি যখন স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিতেছে, তখন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানাইয়াছিলেন, উহাকে মন্দা বলে না— অর্থশাস্ত্রের কেতাব অনুসারে, পর পর দুইটি ত্রৈমাসিকে যদি আর্থিক বৃদ্ধির হার শূন্যের নীচে নামিয়া যায়, একমাত্র তাহাই মন্দা। সংজ্ঞাটি যথার্থ, কিন্তু হায়! অর্থমন্ত্রীও সম্ভবত জানিতেন না, সেই দিন তিনি যে কেতাবি সংজ্ঞাটিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করিয়া সরকারের মুখরক্ষা করিতেছিলেন, সেই সংজ্ঞাও আর আব্রু রক্ষা করিতে পারিবে না। কেতাবের দাবি মিটাইয়া ভারতীয় অর্থব্যবস্থা আর্থিক মন্দায় প্রবেশ করিল। স্বাধীন ভারতে এই প্রথম বার পর পর দুইটি ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার হিমাঙ্কের নীচে। দুনিয়াজোড়া বৃহৎ অর্থব্যবস্থাগুলির মধ্যে ভারতের অবস্থাই শোচনীয়তম। আশাবাদী— বকলমে সরকারবাদী— কতিপয় ব্যক্তি বলিতেছেন, প্রথম ত্রৈমাসিকে ২৩.৯ শতাংশ সঙ্কোচনের পর যখন দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সঙ্কোচনের হার ছয় শতাংশেরও কম, তখন ঘুরিয়া দাঁড়াইবার শুভলগ্ন খুব দূরে নাই। এহেন আশাবাদকে বিপজ্জনক না বলিয়া উপায় নাই। কেন দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সঙ্কোচনের হার কম, তাহার তিনটি সম্ভাব্য উত্তর আছে, এবং কোনওটিই আশাব্যঞ্জক নহে। এক, প্রথম ত্রৈমাসিক জুড়িয়া লকডাউন থাকায় কিছু মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য অর্থ থাকিলেও খরচ করিবার উপায় ছিল না— দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সেই টাকা খরচ হইয়াছে; দুই, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক উৎসবের মরসুম হওয়ায় খরচ বাড়িয়াছে, যাহা পরবর্তী ত্রৈমাসিকে না হওয়াই স্বাভাবিক; এবং তিন, অন্য বহু হিসাবের ন্যায় এই হিসাবেও সরকারি জল আছে। পুনরুত্থান এখনও দূর অস্ত।
কত দূর, তাহাই প্রশ্ন। দেশের শাসকরা ইংরাজি ভি আকৃতির পুনরুত্থানের রেখচিত্রের কথা বলিতেছেন। অর্থশাস্ত্রীদের একাংশের হিসাব, দুই-এক বৎসর নহে, প্রাক্-কোভিড বৃদ্ধির কক্ষপথে ফিরিতে সময় লাগিতে পারে এক বা একাধিক দশক। এবং, সেই হিসাবটিও যে বৃদ্ধির হারকে ধরিয়া কষা হইয়াছে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা টানা এক দশক কখনও সেই হারে বাড়ে নাই। বস্তুত, এক চিন বাদে বিশ্বের কোনও বৃহৎ অর্থব্যবস্থাই দীর্ঘমেয়াদে টানা তেমন চড়া হারে বাড়ে নাই। অর্থাৎ, আর্থিক বৃদ্ধির যে দিগন্ত স্পর্শ করিবার সম্ভাবনা কিছু বৎসর পূর্বেও ভারতের সম্মুখে ছিল, তাহা অন্তর্হিত। কোভিড-১৯’এর উপর সম্পূর্ণ দোষ চাপাইবার উপায় নাই— অতিমারির কবলে পড়িবার পূর্বেই অর্থব্যবস্থা ধুঁকিতেছিল। তখন মন্দার কেতাবি সংজ্ঞার দোহাই না পাড়িয়া ভুলগুলি শুধরাইয়া লইলে আজ হয়তো বিপদের অভিঘাত তুলনায় কম হইত।
কিন্তু, শিক্ষা লইবার সু-অভ্যাস এই সরকারের তেমন নাই। ফলে, প্রসিদ্ধ অর্থশাস্ত্রীরা বারংবার বলিলেও সরকার মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলিয়া দিয়া বাজারে চাহিদা ফিরাইবার পথে হাঁটে নাই। ভারতে জাতীয় আয়ের প্রায় অর্ধাংশই ভোগ্যপণ্যের চাহিদা— সেই চাহিদা তলানিতে পৌঁছাইয়াছে। বহু মানুষের চাকুরি নাই, ফলে খরচ করিবার টাকাও নাই; যাঁহাদের টাকা আছে, তাঁহাদেরও মনে ভরসা নাই। এই বিপন্নতা হইতে প্রথম ত্রৈমাসিকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল সরকারি ব্যয়— দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে তাহাও কমিয়াছে। রাজ্যগুলির হাতে টাকার অভাব প্রকট, ফলে দেশ জুড়িয়াই মূলধনী খাতে ব্যয় কমিয়াছে। অর্থব্যবস্থা কিসের ভিত্তিতে ঘুরিয়া দাঁড়াইবে, সরকারের নিকট সেই প্রশ্নের উত্তর আছে বলিয়া মনে হয় না। তাঁহারা স্মরণে রাখিতে পারেন, শুষ্ক কথায় অর্থনীতির চিঁড়া ভিজে না। কাণ্ডজ্ঞানহীন, কথাসর্বস্ব পরিচালনায় অর্থব্যবস্থা কোথায় পৌঁছাইতে পারে, ভারত তাহা প্রত্যক্ষ করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy