রামনাথ কোবিন্দ যখন ভারতের চতুর্দশতম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন অনেকের মনেই হয়তো সংশয় ছিল যে, তিনি এক উদার, আধুনিকমনস্ক ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হইতে পারিবেন কি না। সংশয়ের কারণ, তিনি সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ। এবং আধুনিকমনস্ক হিসাবে সংঘ পরিবারের বিশেষ সুনাম নাই। কিন্তু সেই সংশয় দূর করিয়া মাননীয় রাষ্ট্রপতি যে ভাবে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালের বক্তৃতায় ভিন্নমতকে সম্মানের এবং মেয়েদের সমানাধিকারের কথা বলিয়া তামাম ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করিয়াছেন, তাহা সত্যই প্রশংসনীয়। প্রশংসার কারণ তিনি কোনও চমক-রাজনীতির পথে হাঁটেন নাই। সোজা কথাটি সোজা ভাবে বলিয়াছেন। বিশেষত, তিন তালাক-সংক্রান্ত বিতর্ক প্রসঙ্গে তিনি অত্যন্ত জরুরি একটি কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন— শুধুমাত্র সরকারি নীতি ও আইন মেয়েদের ন্যায়বিচারের জন্য যথেষ্ট নহে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন, সমাজ এবং পরিবার যাহাতে মেয়েদের কথা শুনে, তাহা নিশ্চিত করা।
কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই একটি কথার মধ্য দিয়ে বাহিরের যাবতীয় চাকচিক্যের অসারতা স্পষ্ট হইয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর সাধের ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’-এর বহুল প্রচার সত্ত্বেও যে ভারতীয় ‘বেটি’-দের মৌলিক অধিকারগুলি সম্পূর্ণ রক্ষিত হয় নাই, তাহার অন্যতম কারণ, সমাজ এবং পরিবারই সেই পথে বাধা হইয়াছে। এখনও সমাজের চোখে মেয়েদের নিজস্ব মত, স্বাধীনতার দাবি, উচ্ছৃঙ্খলতারই নামান্তরমাত্র। গভীর রাতে কর্মস্থল হইতে ফিরিবার পথে হেনস্তা হতে হইলে, হেনস্তাকারী নহে, বরং মেয়েটির চরিত্র, চাকরির ধরন লইয়া চর্চা চলে। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো একাধিক রাজ্যের মোড়ল-সমাজের কল্যাণে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা, নিজ পছন্দে বিবাহের মতো সামান্য স্বাধীনতাটুকুও প্রতিনিয়ত খর্ব করা হয়। বস্তুত, ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বিভিন্ন নেতা তাঁহাদের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে বিভিন্ন সময় ব্যবহার করিয়া আসিয়াছেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তব যে অন্য কথা বলে, সেই বিষয়ে তাঁহারা যারপরনাই উদাসীন। না হইয়াও উপায় নাই, কারণ তাঁহাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতাও মোড়ল-সমাজ অপেক্ষা কিছু ভিন্ন নহে।
অথচ, স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে ভারতকে আধুনিক বানাইবার লক্ষ্যে এই অনগ্রসর, নিয়ন্ত্রণকামী মানসিকতাকেই নাকি বর্জনের ডাক দিয়াছিলেন নেহরু বা অম্বেডকরের মতো নায়করা! নানা মতবিরোধ থাকিলেও এই বিষয়ে তাঁহারা একমত হন, গ্রামসমাজের উন্নতির মাধ্যমে আধুনিক ভারত গঠন করিবার পথটি বিশেষ কার্যকর হইবে না। বরং পশ্চিমি ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’-এর উপর জোর দেওয়াই অধিক প্রয়োজনীয়। সংবিধানেও সেই চিন্তারই প্রতিফলন দেখা যায়। ব্যক্তি-স্বাধীনতার দিক হইতে ভারতীয় সংবিধান অত্যন্ত আধুনিক। কিন্তু দেশজ ‘কমিউনিটি’গুলি সেই আধুনিকতার খুব সামান্যই গ্রহণ করিয়াছে। বরং সেখানে গ্রামসমাজের অন্ধকার দিকটিই সসম্মানে বর্তমান। সেই বিরাট অন্ধকার পার হইয়া মেয়েরা স্বাধীন হইবে কী রূপে? আইনি অধিকারের কথা শুনিতে হইলেও তো সর্বাগ্রে সমাজের কানটি খুলিতে হয়। সার কথাটিই বলিয়াছেন কোবিন্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy