বন্ধ
রেতে মশা দিনে মাছি,/ এই তাড়্য়ে কল্কেতায় আছি: বলিয়াছিলেন উনিশ শতকের কবি। দুই শতাব্দী পার হইয়াছে, বাংলার জনজীবনও বৈচিত্রে পূর্ণতর হইয়াছে। এখন এই রাজ্যে কোনও দিন ঘোষিত বন্ধ, কোনও দিন আকস্মিক অবরোধ— ইহাই নাগরিক দিনযাপন। বুধবার বিজেপি-আহূত বন্ধের আগেই সোমবার আগাম ঘোষণাহীন দীর্ঘ রেল অবরোধে বিপর্যস্ত হইল দক্ষিণ-পূর্ব রেল-সংযোগ, স্তব্ধ হইল তৎসন্নিহিত সড়ক চলাচল। বুঝাইয়া দিল, এই দেশে এবং এই রাজ্যে প্রশাসন নামক বস্তুটি অন্তর্হিত হইয়াছে বলিলেই চলে। চল্লিশটিরও বেশি ট্রেন যদি দিনব্যাপী আটকাইয়া থাকে, তবে কত সংখ্যক মানুষ বিপন্ন হইয়া পড়েন, তাহার একটি মোটের উপর হিসাব নিশ্চয় রেল কর্তৃপক্ষের এবং রাজ্য প্রশাসনের আছে। কিন্তু দুই তরফেই সারা দিনব্যাপী যে নিশ্ছিদ্র নিষ্ক্রিয়তার বহর দেখা গেল, তাহা ভয়ানক। জনজাতি সংগঠনের আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দাবি লইয়া অবরোধে বসিয়াছিলেন। প্রশাসনের তরফে গোটা দিনের মধ্যে কোনও আলাপ বা আলোচনার উদ্যোগ ঘটিল না, জরুরি অবস্থাকালীন প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা তো দূরস্থান। জানা গেল, অনেক রাতে পুলিশ কর্তার সহিত অবরোধকারীদের আলোচনা ব্যর্থ হইয়াছে। অবশ্য শিক্ষাসংক্রান্ত দাবি লইয়া পুলিশকর্তা কী কথা বলিলেন, তাহা পরিষ্কার নহে। শিক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করিয়াছেন, এ সবই বিরোধীদের চক্রান্ত। চক্রান্ত-তত্ত্বটি শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁহার শীর্ষ নেত্রীর খুবই পছন্দসই। ঘটনাস্থলে হয়তো বা বিবিধ ধরনের ‘চক্রান্ত’ ছিলও বটে। কিন্তু তাহা হইতে এই সিদ্ধান্ত করা যায় না যে, প্রশাসনের একমাত্র কাজ নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় আসীন থাকা। গোটা দিন জুড়িয়া শিশু বয়স্ক অসুস্থ-সহ যে অসংখ্য যাত্রীকে চরম দুর্ভোগের মুখে পড়িতে হইল, প্রচণ্ড গরমে খাবার ও জলের অভাবে দিশাহারা হইয়া ছোটাছুটি করিতে হইল, তাঁহারা অধিকাংশই এই রাজ্যের নাগরিক, বিপদে তাঁহারা এই রাজ্যের প্রশাসনের সহায়তাই আশা করেন। ‘অবরোধ তুলিতে রেল কি কোনও ব্যবস্থা করিয়াছে’, শীর্ষক অভিযোগের পিছনে লুকাইয়া যে প্রশাসক নিজেদের দায়িত্ব এড়াইয়া যাইবার চেষ্টা করেন, তাঁহার ও তাঁহাদের জনপ্রিয়তা বাড়িবার কোনও কারণ নাই।
মন্ত্রী-কথিত ‘বিরোধী চক্রান্ত’ বিষয়ে আরও কিছু কথা না বলিলেই নহে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেত্রে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়াইয়া রাজনৈতিক সুবিধা কুড়াইবার চেষ্টা (সচরাচর যাহা ঘোলা জলে মাছ ধরা বলিয়া পরিচিত) চলিতেই থাকিবে, সন্দেহ নাই। ইসলামপুরের ঘটনা তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ। নির্বাচন যত আগাইয়া আসিবে, পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে বিপর্যয় ততই বাড়াইবার চেষ্টা চলিবে, প্রশাসনের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বিরোধিতার পরিসরটিও বাড়াইবার চেষ্টা থাকিবে। কিছু মহলে অনুমান যে এ রাজ্যে জনজাতি বিক্ষোভ বাড়াইতেও বিরুদ্ধ রাজনীতি এখন অতিমাত্রায় সক্রিয়। কিন্তু এই সকলই তো জানা কথা। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের আগাম সতর্কতা লইবার বাধা কোথায়? সঙ্কট শুরু হইলে দ্রুত পদক্ষেপ করা হয় না কেন? অবরোধ নিশ্চয় এক সময় আপনা-আপনি দুর্বল হইবে, আর তাহাও না হইলে তখন পদক্ষেপ করিব— ইহা কি দায়িত্বজ্ঞানহীন মানসিকতা নয়? কাহাদের অসুবিধার গহ্বরে নিক্ষেপ করিয়া প্রশাসন তাহার কর্মপদ্ধতি রচনা করিতেছে? রাজনীতিতে শাসক ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলিতেই থাকে, কিছু কিছু সময়ে তাহা বাড়িয়া সঙ্কটেও পরিণত হয়। কিন্তু কেবল বিরোধীদের মোকাবিলা করার দায়টুকুই তো প্রশাসনের নহে, আরও অতিরিক্ত একটি দায়িত্ব আছে: নাগরিক সুরক্ষার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব হইতে বিচ্যুতি যদি এমন মাত্রাছাড়া হইয়া যায়, তবে শুধু বিরোধীরা কেন— সাধারণ নিরপেক্ষ নাগরিকও এক বাক্যে বলিবেন, পশ্চিমবঙ্গ এখন পরিব্যাপ্ত বিপর্যয়ে নিমজ্জমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy