রাজ্যপাল পদটি কী ও কেন, সে বিষয়ে ভারতীয় সংবিধানে কিছু জরুরি রূপরেখা ছিল। তন্মধ্যে সর্বাধিক গুরুতর কথাটি ছিল ইহাই যে, রাজ্যপালের পদটিকে ‘গুরু’ হিসাবে না লইয়া কিঞ্চিৎ ‘লঘু’ হিসাবেই লইতে হইবে— রাজনীতিতে তাঁহার কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকিবে না। অর্থাৎ পদটি আলঙ্কারিক, তাই অলঙ্কারের মতোই বাহ্যিক ও লঘু হিসাবে পদটিকে গ্রহণ করিতে হইবে। মুশকিল হইল, অন্যে যদি বা এই কথা মনে রাখেন, রাজ্যপালদের অনেকেই এই সাংবিধানিক সতর্কবার্তাটির মর্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন না। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক রাজ্যে প্রেরিত হইবামাত্র তাঁহারা নিজেদের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক দূত বলিয়া মনে করিতে শুরু করেন, এবং কারণে অকারণে রাজ্য রাজনীতিতে মাথা গলাইয়া নিজেদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। বাস্তবিক, কেন্দ্র ও রাজ্যে যদি আলাদা দল ক্ষমতাসীন থাকে, এবং উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়, বিবিধ পথেই কেন্দ্রীয় সরকারের অপ্রীতি কিংবা আপত্তি জানাইবার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু রাজ্যপালকে দূত হিসাবে ব্যবহার করিবার মতো সর্বাপেক্ষা অসাংবিধানিক পথটিই বাছিয়া লইতেছে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে চালিত সরকার।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কথাই ধরা যাউক। বালাকোটে কেন্দ্রীয় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বিষয়ে প্রশ্নকারীদের শ্রীযুক্ত ত্রিপাঠী সাপের সহিত তুলনা করিয়াছেন। এবং সতর্ক করিয়াছেন যে, সময় আসিলে সেই সাপদের দুগ্ধপান না করাইয়া মারিয়া ফেলার বন্দোবস্ত হইতে পারে। রাজ্যপালের মুখে এই ধরনের উক্তি স্তম্ভিত করে। বালাকোটের ঘটনার পরে বিজেপি নেতারা অনেকেই যত্রতত্র যে ধরনের উক্তি করিয়া বেড়াইতেছেন, রাজ্যপালের কথায় যেন তাহারই প্রতিধ্বনি। রাজ্যপাল কোনও ভাবেই কোনও দলের সহিত এই ভাবে নিজেকে একাত্ম ঘোষণা করিতে পারেন না। তিনি যদি একাত্মতা অনুভব করেন, তবুও না। হয় তাঁহাকে ভাবনাচিন্তার দিক দিয়া দলীয় সাধনার ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, নতুবা ভাবনাচিন্তায় দলসাধনা কাটাইতে না পারিলে, ভাবনা ও উচ্চারিত কথার মধ্যে অন্তত কিছু ব্যবধান রচনা করিতে হইবে। নিজেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা মনে করিলেও রাজ্যপাল পদের সম্মানে কথাবার্তায় সংযত হইতে হইবে। দ্বিতীয়ত, ত্রিপাঠীর বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টত একটি হুমকি আছে। যে কোনও উচ্চপদস্থ নেতার মুখেই এমন হুমকি রাজনৈতিক অনাচারের পর্যায়ে পড়ে। বিশেষত রাজ্যপালের মতো সম্মাননীয় পদে যিনি অধিষ্ঠিত, তাঁহার নিকট হইতে তো এমন কথা অকল্পনীয়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোন নিম্নতলে অবনমিত হইয়াছে, এই একটি দৃষ্টান্তই তাহার প্রমাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রীযুক্ত ত্রিপাঠী এই প্রথম তাঁহার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করিলেন না। ইহার পূর্বেও একাধিক ক্ষেত্রে তাঁহাকে ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া বিজেপির দৌত্য করিতে দেখা গিয়াছে।
কেবল ত্রিপাঠী নহেন। কিছু দিন আগে মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায়ও কাশ্মীর ও কাশ্মীরিদের বয়কট করিবার নিনাদ ধ্বনিত করিয়াছেন। তাঁহার মনে হয় নাই যে, দেশের এক প্রদেশের রাজ্যপাল হইয়া আর এক প্রদেশের মানুষদের সংস্পর্শ পরিহার করিয়া চলিতে বলার মধ্যে অক্ষমণীয় অসাংবিধানিকতা রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে মোদী রাজত্বের ইহা একটি ‘গৌরবময়’ অর্জন। আগেও বহু রাজ্যপালকে সীমা অতিক্রম করিতে দেখা গিয়াছে। কিন্তু গত কয়েক বৎসরে যে অপার সহজতায় তাঁহারা সকল ঔচিত্যবোধ পদদলিত করিয়াছেন, কর্নাটক মেঘালয় পশ্চিমবঙ্গ, একের পর এক প্রদেশ তাহার উদাহরণ। নরেন্দ্র মোদী নিজে সংসদকে প্রণাম করিয়া প্রবেশ করার পরমুহূর্ত হইতেই সাংবিধানিক রীতিনীতি নানা ভাবে অমান্য করিয়াছেন। তাঁহার আমলের রাজ্যপালদের অসাংবিধানিক আচরণও ইতিহাসে খোদিত থাকিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy