Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আপনার অভিমত

শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় গড়তে চাইলেন বলেন্দ্রনাথ

৮ পৌষ বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের শতবর্ষ পেরিয়ে এল। বাংলার শিক্ষাকাশে যা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর নেপথ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রও। লিখছেন রাহুল হালদার৮ পৌষ বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের শতবর্ষ পেরিয়ে এল। বাংলার শিক্ষাকাশে যা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর নেপথ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রও। লিখছেন রাহুল হালদার

বলেন্দ্রনাথ

বলেন্দ্রনাথ

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:০২
Share: Save:

১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের পূজা অবকাশের কিছু আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দিন কবি অ্যান্ড্রুজ এবং নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথের কাছে উক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষাসম্পর্কিত আলোচনায় বসেন। সেখানে তিনি বলেন যে, তাঁর অনেক দিনের মনের ইচ্ছা তিনি ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয়কে ভারতীয় শিক্ষাকেন্দ্র করে গড়ে তুলবেন। এই ঘটনার কিছু দিন পর কবি যখন কলকাতায় ছিলেন তখন অ্যান্ড্রুজ কিছু গুজরাতি ব্যবসায়ীদের নিয়ে জোড়াসাঁকোয় কবিগুরুর বাড়িতে উপস্থিত হলেন।

দিনটি ছিল ৫ অক্টোবর ১৯১৮। বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। সেই কারণে অ্যান্ড্রুজ দ্বারা রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যাওয়া গুজরাতি ব্যবসায়ীরা যখন কবিকে অর্থের বিষয় সম্পর্কে আশ্বস্ত করলেন, তিনি সেই বছরেই পৌষমেলার সূচনার পরের দিন, ৮ পৌষ শান্তিনিকেতনের দক্ষিণে মহা সমারোহে নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করে বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন।

১৯১৮ সালে ৮ পৌষ বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হলেও বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবাসীর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন ১৯২১ সালে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় থেকে বর্তমান অবধি যে ভাবে এই শিক্ষাকেন্দ্র বাংলার শিক্ষাভাবনাকে উত্তোরণের পথে নিয়ে গিয়েছে, তা অকল্পনীয়। তাই এই সময়ে বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের শতবর্ষ উদ্‌যাপন নিঃসন্দেহে এক আনন্দঘন সময়।

বিশ্বভারতী নামে যে মহীরুহটি আজ তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে অসংখ্য মানুষের মনে জ্ঞানের স্পৃহা জ্বালিয়ে চলেছে, সেই বীজ বপনের চিন্তাভাবনা এবং তাঁর নিয়ম-নির্দেশিকা খসড়া রূপায়ণ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে হয়নি। সেটি রূপায়িত হয়েছিল তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মস্তিষ্ক থেকেই।

১৮১০ শকাব্দের ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় ‘শান্তিনিকেতন’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হল যে, ঈশ্বর ভক্তজনেরা যেমন তীর্থ আশ্রয় গ্রহণ করেন, তেমনই মহর্ষি ব্রহ্মসাধনের জন্য একটি তীর্থস্থান নিদিষ্ট করেছেন। সে জায়গাটি বীরভূমের অন্তর্গত বোলপুরের শান্তিনিকেতন।—‘‘ব্রহ্মদিগের উপকারার্থে ঐ স্থান উৎসর্গ করিলেন, ব্রহ্মসন্তান সকল ব্রহ্মজ্ঞান লাভার্থে ঐ স্থানে যাইবেন। উহা ব্রহ্মচিৎ সাধুলোকের আশ্রয়ভূমি হইয়া রহিল।’’

ব্রাহ্মসমাজের মানুষদের জন্য শান্তিনিকেতন স্থানটি উৎসর্গ করার লক্ষ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ‘ট্রাস্ট ডিড’ লিপিবদ্ধ করেন। সেখানে বলা হল—‘‘এই ট্রাষ্টের উদ্দিষ্ট আশ্রমধর্মের উন্নতির জন্য ট্রষ্টীগণ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় ও পুস্তকালয় সংস্থাপন, অতিথি সৎকার ও তজ্জন্য আবশ্যক হইলে উপযুক্ত গৃহনির্মাণ ও স্থাবর অস্থাবর বস্তু ক্রয় করিয়া দিবেন এবং ঐ আশ্রমধর্মের উন্নতির বিধায়ক সকল প্রকার কর্ম করিতে পারিবেন।’’

সেই সময়ে মহর্ষির পৌত্র বলেন্দ্রনাথ (বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র) এক বার একেশ্বরবাদীদের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে একত্রে কাজ করার অভিপ্রায়ে পঞ্জাব গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁদের বেদসর্বস্ব মনোভাব ও মতবাদের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যুক্তি ও ভক্তিমিশ্রিত ব্রহ্মবাদের মিলন সম্ভব নয় বুঝতে পেরে, পঞ্জাব থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে এসে মনস্থির করলেন শান্তিনিকেতনের ট্রাস্ট ডিডে যেহেতু ব্রাহ্মসমাজের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের কথা উল্লিখিত আছে, তাই তিনি সেখানে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করবেন। মনের এই ভাবনার কথা মহর্ষিকে জানালে মহর্ষি সেই ভাবনাকে যথোপযুক্ত মনে করে সম্মতি দিলেন। নব উদ্যমে বলেন্দ্রনাথ তাঁর ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন।

প্রথমে তিনি শান্তিনিকেতনে ১৩০৪ সনে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ আরম্ভ করেন এবং সেই ব্রহ্মবিদ্যালয়ের নিয়মাবলির একটা খসড়া তৈরি করেন। খসড়াটি যেটুকু অংশ রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেটি সংক্ষেপে এই রকম— এক, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা উপযোগী করে অধ্যাপনা করা হবে। দুই, বিদ্যালয় ছয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা হবে। তিন, আপাতত দশ জন ছাত্র বিনা ব্যয়ে বিদ্যালয়ে থেকে খাওয়া-দাওয়া ও বিদ্যালাভ করতে পারবে। চার, খাওয়ার খরচের জন্য মাসে ১০ টাকা দিলে আরও ২০টি ছাত্রকে বিদ্যালয়ে নেওয়া যাবে। পাঁচ, শান্তিনিকেতন আশ্রমের ট্রাস্টগণেরা ছাড়াও আরও চার জন সভ্যকে নিয়ে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সমিতি তৈরি করা হবে। ছয়, শান্তিনিকেতন ট্রাস্টগণের মধ্যে এক জন বিদ্যালয়ের সম্পাদক হবেন। সাত, অধ্যক্ষ সমিতি ব্রহ্মধর্মানুমোদিত শিক্ষা প্রণালী এবং শান্তিনিকেতনের আশ্রমের নিয়মাবলি সম্পূর্ণ রূপে রক্ষা করে বিদ্যালয়ের কাজ পরিচালিত হবে। আট, বিদ্যালয়ের অন্য পাঠগ্রন্থের সঙ্গে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে ‘পদ্য ব্রাহ্মধর্ম’ এবং চতুর্থ বার্ষিক থেকে প্রবেশিকা পর্যন্ত ‘ব্রাহ্মধর্ম ও ব্যাখ্যান’ পড়তে হবে। নয়, তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণি থেকে এন্ট্রাস পর্যন্ত সকল ছাত্র অধ্যাপকরা আশ্রমের প্রতি সান্ধ্য উপসনায় যোগ দিতে হবে। বারো, সকল ছাত্রকেই বিদ্যালয়ের ভবনে থাকতে হবে এবং শিক্ষকেরা তাদেরকে নিয়ে নিদিষ্ট সময়ে খাওয়াদাওয়া করবেন।

এ ছাড়াও, ছুটির সময় ছাড়া মাসে তিন দিন অভিভাবকের সম্মতি থাকলে অধ্যাপকের অনুমতি নিয়ে ছাত্রেরা বাড়ি যেতে পারবে। অভিভাবকেরা প্রতি রবিবারে গিয়ে বালকদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, বলেন্দ্রনাথের দ্বারা ব্রহ্মবিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ ও বিদ্যালয়ের নিয়মাবলির খসড়া তৈরি হলেও বিদ্যালয় আরম্ভ হওয়ার আগে তিনি মারা যান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমসাময়িক কালে জমিদারির কাজে শিলাইদহে থাকছিলেন। সে সময়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ তিনি দিতে পারেননি। যে কারণে তিনিও সে সময়ে মনে মনে একটি বিদ্যালয় স্থাপনের কথা ভাবছিলেন। যদিও তিনি শিলাইদহে গৃহবিদ্যালয় চালু করেছিলেন। বলেন্দ্রনাথের অসমাপ্ত শিক্ষা পরিকল্পনার প্রতি কবিগুরুর পূর্ণ সমর্থন ছিল বলেই তিনি তাঁর মনে ভাবনাকৃত বিদ্যালয়টি শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবে লিখেছিলেন— ‘‘আমি পিতাকে জানালেম, শান্তিনিকেতন এখন প্রায় শূন্য অবস্থায়, সেখানে যদি এক আর্দশ বিদ্যালয় স্থাপন করতে পারি তা হলে তাকে সার্থকতা দেওয়া হয়। তিনি তখনই উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিলেন।’’ পিতার সম্মতি পাওয়ার পরে বলেন্দ্রনাথের অসমাপ্ত কাজের পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছরেই ১৩০৬ সনে ৭ পৌষ মহর্ষির ব্রাহ্মধর্মের দীক্ষাদান দিনের উৎসবের মধ্যে দিয়েই ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়।

সুতরাং, সেই ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে বিদ্যালয়টি বিশ্বভারতীতে রূপান্তরিত হয়। তাই এর গড়ে ওঠার নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানের সঙ্গে সঙ্গে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানকেও অস্বীকার করা যাবে না।

(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE