তুমি ওকে সব খুলকে বাতাওনি?’
রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ-ই প্রশ্নটা কানে এল। তাকিয়ে দেখি, সাইকেলে চলেছে দুই যুবক। হয়ত কলেজ পড়ুয়াই হবে। কিন্তু এ কোন ভাষা?
বাংলা আছে। কিন্তু হিন্দিই বেশি। আগে হিন্দি-বাংলার মিশ্রিত বাক্য অনেক শুনেছি। ‘হিসাব বরাবর’, ‘পাঙ্গা নিবি না’, ‘আমি খেলব না, কেন কী আমাকে বাড়ি যেতে হবে’, ‘মজা এসে গেছে’ ইত্যাদি। এমনকি, ‘একটু ঘুমে আসি’ও শোনা হয়ে গেছে। কিন্তু হিন্দি বাংলার এমন অদ্ভুত মিশ্রণ আগে শুনিনি।
বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষা থাকে এ আমাদের সকলের জানা। এ-ও জানা আঞ্চলিক উপভাষা থাকলেও যে-কোনও উপভাষী অঞ্চলে বিভিন্ন স্তরের মানুষদের বাংলার মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে। যে কারণে ইংরেজি মিডিয়ামের বাংলা, কলেজ পড়ুয়াদের বাংলা, রকবাজদের বাংলা, চোর-গুন্ডা বদমাশদের বাংলা আলাদা আলাদা হয়। এর কারণ, কথ্য ভাষার দু’টি রূপ। আঞ্চলিক উপভাষা আর সমাজ ভাষা। বিভিন্ন স্তরের ভাষার পার্থক্য সমাজভাষার বিষয়। কিন্তু সমাজভাষা যেমনই হোক তা শিকড় ছাড়া হতে পারে না। আঞ্চলিক উপভাষার একটা আদল তাতে থাকবেই। কলেজ পড়ুয়া যুবকটির প্রশ্নের মধ্যে কিন্তু সেটুকুও নেই।
পণ্ডিতেরা বলেন, কথ্যভাষা নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই। একটা শক্তিশালী ভাষা প্রতিবেশ থাকলে স্থানীয় কথ্যভাষা বদলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। পাশে ইংরেজি থাকলে বাংলা এক রকম হবে, পাশে হিন্দি থাকলে বাংলা এক রকম হবে। পণ্ডিতদের মত, মান্য লিখিত ভাষাটা ঠিক থাকলেই হল। কিন্তু মান্য লিখিত ভাষা মানে তো সেই চলিত ভাষাই। এবং সে চলিত ভাষাও যাতে কথ্য ভাষার কাছাকাছি হয়, তা নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, স্বামী বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরী প্রমুেখরা অনেক দিন আগেই সওয়াল করে গিয়েছেন। এই মর্মে বাংলা সাহিত্যে প্রচেষ্টাও আজকের নয়। উপন্যাসে, নাটকের সংলাপে কথ্য ভাষা গৃহীত হয়েছে অনেক দিন আগেই। সুতরাং কথ্য ভাষা দূষিত হলে তার ছাপ লিখিত ভাষাতে আসবেই। আসছেও। চেয়ার, টেবিল, সাইকেল, পুলিশ, ফর্দ এই সব বিদেশি শব্দকে কেউ জোর করে বাংলায় ঢোকায়নি। সময়ের সঙ্গে এ সব আপনিই প্রবেশ করেছে। কিন্তু এখন চলছে জবরদস্তি। ইংরেজি শব্দ, ইংরেজি বাক্য গঠনপ্রণালী বাংলায় ঢুকে যাচ্ছে অবলীলায়। হজম করার সময়টুকুও দেওয়া হচ্ছে না। হিন্দির প্রভাবও একই রকম। ‘উনি আমার কাকা হচ্ছেন’, ‘মা আমাকে বলল কী আমি এখন বড় হয়েছি’ জাতীয় বাক্য, ‘বিন্দাস’, ’কেনকী’, ‘অন্তাকশরী’ ইত্যাদি শব্দ এখন বাংলা লিখিত ভাষাতেও ঢুকে পড়ছে।
কথ্যভাষা ঠিক ভাবে বলতে না পারার জন্য লিখিত ভাষাতেও ঢুকছে নড়বড়ে শব্দ, ভুল শব্দ। ‘এইসব ছাত্ররা’, ‘মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে’, ‘নয় আদবানি, নয় অটলবিহারী’ ইত্যাদি তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে ‘শ্রমজীবি’, ‘শিক্ষন’, ’প্রাঙ্গন’ ইত্যাদি ভুল বানানের ছড়াছড়ি। কম্পিউটারের সাহায্যে আজকাল ছাপা হয় বইপত্র। সেখানে স্পেলচেক আছে। তবু বানান ভুল থেকে মুক্ত নয় প্রায় কোনও কিছুই, এমনকী ছাত্রদের দেওয়া সরকারি বইপত্রও।
সব মিলিয়ে একটা ছবি পরিষ্কার। পিছু হটছে বাংলা ভাষা। এই পিছু হটা রোখার জন্য শিক্ষিত বাঙালি তৎপর তো নয়ই, আগ্রহীও নয়। বাংলা দিয়ে কিছু হবে না, এটাই বেশিরভাগ শিক্ষিত বাঙালি এখন মনে করেন। ফলে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমছে ক্রমাগত। আনাচে-কানাচে গজিয়ে উঠছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এই সব স্কুলে ইংরেজি কতটা শেখা যাচ্ছে তা যারা শিখছে তারাই জানে। কিন্তু এই সব স্কুলের সৌজন্যে ছেলেমেয়েদের কাছে মাতৃভাষা বাংলাটা চলে যাচ্ছে প্রায় অবহেলার পর্যায়ে।
ভাষাবোধ গড়ে ওঠে সাহিত্যপাঠ থেকে। কিন্তু সাহিত্যপাঠ বাঙালি জীবন থেকে এখন এক রকম উঠেই গিয়েছে। বহু বাঙালি সাহিত্য বলতে বোঝে খবরের কাগজ। বাংলা মিডিয়ামে পড়া বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আগ্রহী নয়। যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে, তাদেরও অনেকে দায়সারা সাহিত্যপাঠকে উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা বইয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। আর যারা একেবারে বাংলা নিয়েই পড়ে, তাদের অনেকর অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। পাঠ্য গল্প-উপন্যাসের বাইরে তারা সে ভাবে আর কিছু জানে না। ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিন্তু সাধারণ চিত্র এটাই।
বাংলা নিয়ে প্রশাসনিক স্তরেও চিন্তা-ভাবনা কম। এখনও সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি, নির্দেশনামা সব ইংরেজিতেই। ঘরে বাইরে বাংলা ভাষার অজস্র শত্রু। কিন্তু সবচেয়ে বড় শত্রু বোধহয় আমরাই। যে জন্য বাংলা বর্ণমালাকে বিসর্জন দিয়ে ইংরেজি বর্ণে তা লেখা যায় কিনা সে ভাবনাচিন্তাও হচ্ছে। শহরাঞ্চলে দোকানে দোকানে সাইনবোর্ডে ইংরেজি নাম যতটা উজ্জ্বল ভাবে লেখা হচ্ছে, বাংলা ততটা নয়। কোনও কোনও জায়গায় দোকানের সাইনবোর্ডে তো বাংলা পুরোপুরিই অনুপস্থিত। সবথেকে আশ্চর্যের কথা, ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে না পারলে এ বঙ্গেরই অনেক জায়গায় প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় না।
রবীন্দ্রনাথ এক শ্লেষাত্মক গানে বঙ্গজননীর ভাষা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাষা হায়/সবে ভুলিতে চায়।’ এই কথায় সে যুগে শ্লেষ থাকলেও, এখন আর তা নেই। এখন বাংলা ভুলতে চাওয়াটাই বাঙালির প্রাত্যহিক বাসনা। এবং সেটাই যেন বড় অহঙ্কার।
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল
তথ্যঋণ: ‘বাঙালির ভাষা’/
সুভাষ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy