মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা নিদর্শন। ইতিহাস সমৃদ্ধ নবাবদের রাজত্বকাল বাদ দিলেও রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা আর নানা ব্যক্তিত্ব। মুর্শিদাবাদের লালগোলা তেমনই একটি জায়গা। লালগোলার রথবাজার পেরিয়ে এমএন একাডেমি স্কুলের আগে মনসা মন্দিরের বাঁ দিকে একটি হলুদ রঙের জীর্ণ মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা আজ আমাদের অনেকেরই মনে নেই। ইতিহাস সচেতন মানুষ অবশ্য এই বাড়ির গুরুত্ব জানেন। লালগোলার মহারাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় তাঁর পৌত্র ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জন্য এক জন গৃহশিক্ষকের খোঁজ করছিলেন। তলব করা হল তাঁকে। তিনি তখন মুর্শিদাবাদের অরঙ্গাবাদের নিমতিতায় একটি স্কুলের শিক্ষকতা করছেন।
যেখানে স্বয়ং রাজা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন, না গিয়ে আর উপায় কী! সেই ডাকে সাড়ে দিয়ে চলে আসেন লালগোলা। কিছু দিন ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়কে পড়ানোর পরে রাজা তাঁকে লালগোলার এমএন একাডেমিতে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হতে বলেন। আর তখন থেকেই পাকাপাকি ভাবে তিনি থাকতে শুরু করেন এই বাড়িতে। সেই বিখ্যাত মানুষটি আর কেউ নন, যোগী বরদাচরণ মজুমদার। বরদাচরণেবার ডাকে সাড়া দিয়ে কে না এসেছেন এই বাড়িতে! কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে তবলা শিল্পী ওস্তাদ আতা হোসেন, সঙ্গীত শিল্পী কাদের বক্সের পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল লালগোলার এই বাড়ি। ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক যোগ। চিঠিপত্রের আদান প্রদান চলত তাঁদের মধ্যে। কিন্তু কখনও সরাসরি দেখা করেননি তিনি। তবে এ বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঋষি অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষের। বাংলার আকাশে বাতাসে তখন ধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতার জয়গান। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত প্রাণ বাংলার যুবা-বৃদ্ধ অনেকেই। আর তাঁদের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের বীর সন্তান সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্রের কলেজ জীবনের বন্ধু দিলীপকুমার রায়। তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র। তিনি নিজেও একজন সুরসাধক। তিনিও বহু বার বরদাচরণের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন এই বাড়িতে।
সেই সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক চরম সন্ধিক্ষণ। সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি পদ ত্যাগ করেছেন তখন। মহাত্মা গাঁধীর নেতৃত্বে চালিত সমস্ত কংগ্রেস-শক্তি সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে। নতুন কর্মপন্থা নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের তখন ব্যস্ততার সীমা নেই। সেই সময়ে এক দিন গ্রীষ্মের ছুটিতে লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় কলকাতা বেড়াতে আসেন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে তিনি অতিশয় আগ্রহী। সমস্ত জরুরি কাজ ফেলে সুভাষচন্দ্র সে দিন সকাল আটটার সময় বরদাবাবুর কাছে উপস্থিত হন। তারিখটা ছিল ১৯৩৯ সালের ১২ জুন। বাংলা ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৬ সাল। আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগের এক দিন। সুভাষচন্দ্রকে সঙ্গে করে বরদাচরণ একটি ঘরে প্রবেশ করেন। বরদাচরণ তখন কলকাতায় মোহিনীমোহন রোডের একটি বাড়িতে ছিলেন। ঘরে ঢুকে বরদাচরণ নির্দেশ দেন, তিনি ঘর না খোলা পর্যন্ত কেউ যেন দরজায় ধাক্কা না দেয়। টানা আড়াই ঘণ্টা ভেতরে চলে আলোচনা। আর আলোচনার পরে যখন তিনি বাইরে আসেন তখন দেখা যায় সুভাষচন্দ্রের চোখ মুখ লাল। যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।
সুভাষকে তাঁর গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি একটিও বাক্যালাপ না করে নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়ে বসেন। গাড়িতে ওঠার আগে দেখা যায় তাঁর পদক্ষেপও যেন স্বাভাবিক নয়। পরের দিন সন্ধ্যায় সুভাষচন্দ্র ফের দেখা করতে যান বরদাচরণের সঙ্গে। সোয়া দু’ঘন্টা কাটিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। পরের দিন অবশ্য আসার কথা ছিল না সুভাষের। কী কারণে তিনি এসেছিলেন এবং এতক্ষণ সময় কাটিয়ে গিয়েছেন তা খোলসা করে কিছু বলেননি যোগী মহাশয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পরের দিন বিশেষ কাজে সুভাষের কলকাতার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। উপস্থিত তাঁর কাছের লোকেরা বরদাচরণকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘সব কিছু খুলে বলা সম্ভব নয়। অতীত জীবনটাই সুভাষবাবুর কাছে খুলে ধরেছিলাম। যে কথা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না এমন কথাও তাঁর সামনে তুলে ধরেছিলাম।’’
বরদাচরণ ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে এমন কিছু কথাবার্তা হয় যা চিরকাল কেউ জানবেন না। সুভাষচন্দ্রের সে দিনের আসা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আজ তাঁকে যোগের বিশেষ প্রক্রিয়া বলে দিলাম। ধ্যানে বসিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ ছিলেন!’’ কী এমন বিশেষ আলোচনা হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে, আমরা পুরোপুরি জানি না। সুভাষচন্দ্রের এই জন্মমাসে দাঁড়িয়ে আমাদের তা জানার বিশেষ আগ্রহ থাকলেও আজ তা জানার বিশেষ সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারি যে, এমন কোনও কথা হয়েছিল যার জন্য সুভাষচন্দ্রের চোখ-মুখ সে দিন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে দেওয়া সুভাষ সে দিন হয়তো এমন একজন গুরুর খোঁজেই ছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন কি এমন কিছু মন্ত্র যা তাঁকে পুরোপুরি বাকস্তব্ধ করে দিয়েছিল? ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্রের দেখা হয়েছিল যোগী মহাশয়ের সাথে। আর তার পরেই ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষের অন্তর্ধানের খবর ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
কল্যাণী জেএনএম-এর চিকিৎসক