কিশোরী আমোনকরের গলায় ‘বাবুল মোরা নইহার ছুট হি যায়,’ চলছিল গাড়িতে। তা শুনতে শুনতেই দু’দিন আগে বারাণসী ছাড়লাম আমরা। মনে হচ্ছিল, এমন মিষ্টি গান আর কি হবে কোনও দিন?
অনেক বড় বড় শিল্পীর গান শুনে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই টের পেয়েছি, কিশোরীদির গানে যেন অন্য একটা জাদু আছে। ওঁর ব্যাপারটাই আলাদা। একই গান বাকি সকলের গলায় এক রকম, কিশোরীদির গলায় গেলেই তার মেজাজটা যেন একেবারেই অন্য রকম হয়ে যেত। যেমন সুরেলা গলা, তেমনই সুর লাগানোর আন্দাজ!
সব সময়েই শুনে এসেছি, কিশোরী আমোনকর কাউকে পরোয়া করেন না। নিজের মনের মতো করেই চলেন। তা টের পেয়েছিলাম প্রথম মুম্বইতে এক অনুষ্ঠানে। বছর পঁচিশ আগের কথা হবে। সেইই ছিল কিশোরীদির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তার আগে ওঁর রেকর্ড শুনেছি অনেক, সামনে থেকে শুনলাম সেই প্রথম। সামনাসামনি ওঁর গান শুনে বুঝেছিলাম, কেন তিনি সকলের থেকে আলাদা। পকড়, তৈয়ারি— সবেতেই যেন আলাদা ছোঁয়া। কিশোরীদির মাপের শিল্পী খুব কমই হয়। নিজের ঘরানার মধ্যে থেকেও কী ভাবে যে সব ছাপিয়ে নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করে ফেলতেন অল্প ক্ষণে, সে রহস্য আজও বুঝে উঠতে পারিনি!
আসলে ওঁর এই মেজাজেরও একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কিশোরীদির গুরু মূলত ওঁর মা মোগুবাঈ কুর্দিকর। খুব ছোটবেলা থেকে একেবারে গুরুশিষ্যপরম্পরা মেনে মায়ের কাছে জয়পুর ঘরানায় সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় দিদির। শুনেছি, অনেক দূর শেখার পরে ওঁর মা-ই কিশোরীদিকে পাঠান অন্যান্য ঘরানার গুরুদের কাছে। যাতে এক একটা ঘরানার চর্চার মধ্যে পার্থক্যগুলো শিখতে পারেন তাঁর কন্যা। বিদূষী মায়ের সেই বিবেচনা যে মেয়েকে কতটা স্বতন্ত্র করে তুলল, তা তো গোটা সঙ্গীত দুনিয়াই দেখেছে। সুর লাগানোর ক্ষেত্রে কোনও দিনও নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি তিনি। একটা গান তিনি যত বার গেয়েছেন, তত বার সেটি নতুন রূপ পেয়েছে। একই সুর বার বার এক ভাবে ধরায় বিশ্বাসই ছিল না তাঁর। তেমনই আবার নিজেকে আটকাননি কোনও এক ধারার গানে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যেমন দাপটের সঙ্গে গাইতেন, ততটাই আনন্দে গাইতেন হাল্কা মেজাজের গান। কিশোরীদি তো ফিল্মের জন্যেও গেয়েছেন। ওঁর গলায় ভজন শুনতেও আমার খুব ভাল লাগে।
তবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতই ছিল বেশি পছন্দ। তা নিয়ে কাজ করেছেন অনেক। বলতেন, একটা রাগের দুটো স্বরের মধ্যে এক বিশ্ব আবেগ এবং অনুভূতি রয়েছে। তাই আমাদের সঙ্গীত শ্রুতিনির্ভর, শুধু স্বরনির্ভর নয়। শ্রুতিই বুঝিয়ে দেয়, কী ভাবে একটা স্বর এক এক ভাবে এক একটি রাগের অঙ্গ। দুই স্বরের মাঝের সেই বিশাল দুনিয়াটা উপলব্ধি করা যায় সাধনার মাধ্যমে। সঙ্গীত সম্পর্কে সেই সব ভাবনা ধরা আছে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত তাঁর একটি বইতে। ওঁর উপরে একটি তথ্যচিত্রও হয়েছিল। সেটি বানিয়েছিলেন অমল পালেকর এবং সন্ধ্যা গোখেল। সেখানেও সুর সাধনা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন কিশোরীদি। আসলে গোটা জীবনটাই তো সঙ্গীত নিয়ে কাটিয়েছেন। শুনেছি, চরম ব্যস্ততার মধ্যেও গুনগুন করতেন দিনভর। নিজের সাধনার সম্মানও তেমনই পেয়েছেন সর্বত্র। ১৯৮৭-এ পদ্মশ্রী, ২০০২ সালে পদ্মবিভূষণ পেয়েছেন। এ ছাড়াও যে কত শত সঙ্গীত সম্মান পেয়েছেন!
মুম্বইয়ের যেই অনুষ্ঠানের কথা বলছিলাম, সেখানে আমার গানও শুনেছিলেন কিশোরীদি। মঞ্চ থেকে নামার পরে আমায় আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘বহত খুব। অউর আগে বঢ়ো।’ অন্যদের মুখে পরে শুনেছি, আমার গান শোনার জন্যই নাকি বসেছিলেন সে দিন। এমনিতে তো বেশি মেলামেশা পছন্দ করতেন না। নিজের মতোই থাকতেন, খুব বেশি কথাও বলতেন না। তবে ওঁর ওইটুকু কথা আমাকে আজও এগিয়ে চলার সাহস দেয়। এর কিছু দিন পরেই এক বার কলকাতায় এসেছিলেন। নেতাজি ইন্ডোর স্টে়ডিয়ামের গ্রিন রুমে ঢুকে দেখি, কিশোরীদি বসে। বলে দিয়েছেন, বেশি হইচই চান না। মেজাজ বুঝে নিয়ে উদ্যোক্তারাও কাউকে যেতে দিচ্ছিলেন না ওঁর আশপাশে। আমি সে সব না জেনেই ঢুকে পড়েছি ঘরে। ওঁর এক সঙ্গী ভয়ে ভয়েই আলাপ করিয়ে দিলেন। আমাকে বসতে বললেন। বলে দিলেন, ‘ও তো আমার বন্ধু।’ সে দিন বুঝতে পারলাম, আমাকে পছন্দই করেছেন তিনি।
বছর দুয়েক আগে পুণেতে এক কনসার্টে আবার দেখা হল কিশোরীদির সঙ্গে। ওঁরই এক ছাত্র আয়োজন করেন সেই অনুষ্ঠান। সে দিনই বললেন, শরীরটা বিশেষ ভাল নেই, তাই বেশি ক্ষণ থাকবেন না। আমিও বললাম, পরে কথা হবে। তখন কি জানতাম, সেটাই শেষ দেখা!
অনুলিখন: সুচন্দ্রা ঘটক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy