Advertisement
E-Paper

ধর্মের দোহাই দিয়ে শব্দদূষণ

এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিছু বলা মুশকিল’, শুনিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। শব্দের ও বাতাসের ভয়ানক দূষণ থেকে বাঁচলেন না সাধারণ মানুষ।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১০

মঞ্চে আসীন বিধাননগরের মেয়র ও স্থানীয় বিধায়ক। সামনে কয়েক হাজার মানুষ, সাংবাদিকরাও। সবাইকে সাক্ষী রেখে বিজয়া দশমীর দিন সল্ট লেক সেন্ট্রাল পার্কে সাড়ম্বরে পোড়ানো হল ষাট ফুট রাবণ, কুম্ভকর্ণ-সহ তিনটে মূর্তি। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও রকম বায়ুদূষণ না করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। এই নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কালো ধোঁয়ায় ভরে গেল এলাকার আকাশ, এমন প্রচণ্ড রবে নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো শুরু হল যে, এক কিলোমিটার দূরের দূষণ পর্ষদের অফিসের সামনে থেকেও তা স্পষ্ট শোনা গেল! আর যাদের প্রতি নির্দেশ ছিল দূষণ আটকানোর, সেই পুলিশ ব্যস্ত রইল বেআইনি সমারোহকে সফল করতে! বাইরে বেরিয়ে এক পুলিশি বড়কর্তাকে এমন কাণ্ডের কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি ‘জানেনই তো, এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিছু বলা মুশকিল’, শুনিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। শব্দের ও বাতাসের ভয়ানক দূষণ থেকে বাঁচলেন না সাধারণ মানুষ।

ঘটনা ২: গভীর রাতে ফোন এল পরিবেশ প্রশাসনের এক বড়কর্তার কাছ থেকে, ‘‘গত কয়েক ঘণ্টা ধরে নরক গুলজার চলছে আমাদের এখানে। গণেশ পুজোর ভাসানের নামে প্রায় মাঝরাত অবধি মিছিল চলেছে, সঙ্গে ডিজে বাজিয়ে প্রচণ্ড শব্দে গান আর দেদার চকলেট বোমা ফাটানো চলছে। পুলিশের যে বড়কর্তারা মিটিংয়ে বলেছিলেন, ‘ডিজে বন্ধ’, এখন দেখছি তাঁদেরই ফোন বন্ধ’’, আক্ষেপ আধিকারিকের। সম্ভবত কানও বন্ধ ছিল পুলিশের। গণেশ পুজোর নামে সারা শহর ও শহরতলি জুড়ে চলেছিল মাইক, ডিজে ও বোমের রমরমা। শাসক দলের এক নেতাকে এই অত্যাচার না থামানোর কারণ জিজ্ঞাসা করতে তিনি ফোনের মধ্যেই জিভ কাটলেন, ‘ওরে বাবা! ধর্মের ব্যাপারে কে এখন কথা বলবে?’

যে পশ্চিমবঙ্গ এক সময় আদালত ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যৌথ চেষ্টায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সারা দেশের মধ্যে অবিসংবাদিত সেরা-র সম্মান পেয়েছিল, সেখানে অনেক দিনই শব্দ নিয়ন্ত্রণে ভাটার টান। বাম আমলের শেষ পাঁচ বছর এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ ছ’বছর শাসনকালে যেখানে, যখন খুশি, যত ক্ষণ খুশি শব্দদূষণ করাটা খানিকটা দস্তুর হয়ে পড়েছে, সাম্প্রতিক কালে, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের আশীর্বাদধন্য অনুষ্ঠানগুলিতে তো বটেই। কিন্তু এর আগে তা এমন ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যায়নি। বরং মুখ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যে শব্দের নিয়মভাঙা চিৎকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। রাত্রি দশটার মধ্যে নিয়ম মেনে মাইক বাজানো বন্ধ করতে বলেছেন। এমনকী পত্রপত্রিকায় কলমও ধরেছেন। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে যাবতীয় নিয়ম মানানোর চেষ্টাকে স্রেফ গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। এ কথা স্পষ্টতই বলা যায় যে রাজ্যে মাত্রাছাড়া শব্দদূষণের নতুন ছাড়পত্রের নাম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অজুহাত।

যত বেশি ধর্মের ভিত্তিতে রাজ্য রাজনীতির মেরুকরণ হচ্ছে, বিজেপির ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির বাড়বাড়ন্তকে ঠেকানোর জন্য তৃণমূল কংগ্রেস যত বেশি পালটা ধর্মের তাস খেলা শুরু করছে, ধর্মের দোহাই দিয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে নানা রকমের নিয়ম ভাঙার প্রবণতা। কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংস্থা কোনও অনুষ্ঠান করতে গেলে নিয়মকানুনের যত গেরো পার হতে হয়, তার দশ ভাগের এক ভাগও পোহাতে হয় না কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের। বরং তাঁরা ইচ্ছেমত রাস্তা আটকে, ব্যস্ত সময়ে মিছিল করে, নিয়ম ভাঙার অনুষ্ঠান করেন। পুলিশ সামান্য প্রশ্ন করারও সাহস পায় না।

এমন নয় যে এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি। বাম আমলে আদালত নির্দেশ দিলেও অনুমোদিত সময়সীমার বাইরে আজানের জন্য মাইক বাজানো বন্ধ হয়নি। তবে সেটা ছিল নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বিধিভঙ্গে প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু এখন ধর্মকে কেন্দ্র করে বেলাগাম নিয়ম-ভাঙাকে, বলা ভাল, ‘লুম্পেনাইজেশন’কে আনুষ্ঠানিকতার রূপ দেওয়া শুরু হয়েছে। বিসর্জনের সময় যেমন সর্বসমক্ষে পুলিশকে সাক্ষী রেখে এনতার চকলেট বোম ফাটে, তেমন অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও পাল্লা দিয়ে শব্দতাণ্ডব ঘটে।

এক বার নিয়ম ভাঙলে ক্রমেই নিয়ম ভাঙার মাত্রা বাড়তে থাকে। আর প্রশাসন যদি নিয়ম মানানোর বদলে নিয়ম ভাঙার খেলায় সাম্যবাদ জারি করে, তবে গোলপোস্ট ক্রমেই পিছোবে। আসন্ন কালীপূজা ও দীপাবলির নিরিখে এমনটা মোটেই কাম্য নয়। প্রশাসনের যাবতীয় আনুষ্ঠানিক হাঁকপাঁক সত্ত্বেও আগের বেশ কয়েক বছরের স্মৃতি মোটেই ভরসা দেয় না। হাসপাতালের চার দিকে মধ্য রাত পেরিয়ে বোম ফেটেছে, বোমের আওয়াজে চমকে ওঠার ফলে সুচ খুলে যাচ্ছে আইসিইউ’তে থাকা ছোট্ট শিশুর— এমন নজিরও বিস্তর।

শব্দ দূষণ রোধে পশ্চিমবঙ্গের অতীত সাফল্যের পিছনে আদালতের নির্দেশের বড় ভূমিকা ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই নির্দেশ বাস্তবে কার্যকর হয়েছিল সমাজের একটা বড় অংশ সেই রায়কে মন থেকে গ্রহণ করার ফলে। পর্ষদের তৎকালীন আধিকারিকদের কাছে জানা যায়, সেই সময় এক সমীক্ষায় রাজ্যের ৯৫ শতাংশ মানুষ শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রদত্ত আদালতের রায়কে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ১৯৯৭ থেকে একুশ শতকের গোড়া অবধি পশ্চিমবঙ্গে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাহিনিতে নিহিত আছে একটি সার্থক গণ-আন্দোলনের ইতিহাস।

জননেত্রী বলে সর্বদা পরিচিত হতে চাওয়া, বার বার ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রমাণের চেষ্টা করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বে কি সেই ইতিহাসের চাকা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরবে? রাজ্যে আক্ষরিক অর্থে সুস্থ পরিবেশে বাঁচতে চাওয়া সাধারণ মানুষ উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন।

Sound pollution Festival religious matter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy