Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়?’

নেতা জন্ম নেয়। নেত্রীকে সমাজ নির্মাণ করে। এই নির্মাণের ভিত মহুয়ারা আরও পোক্ত করেন। ভরসা জোগান মিমি, নুসরতেরা। ওঁদের কুর্নিশ। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামনেতা জন্ম নেয়। নেত্রীকে সমাজ নির্মাণ করে। এই নির্মাণের ভিত মহুয়ারা আরও পোক্ত করেন। ভরসা জোগান মিমি, নুসরতেরা। ওঁদের কুর্নিশ। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৯ ০১:১৫
Share: Save:

তিন মহিলা সাংসদ। তিন লড়াই। তিন কাহিনি। ওঁরা মহুয়া মৈত্র, নুসরত জাহান এবং মিমি চক্রবর্তী। তাঁরা রোদে পুড়লেন। ঘামে ভিজলেন। নিন্দা, টিপ্পনী ও অপপ্রচার উপেক্ষা করে ভোট-ময়দানে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়লেন। এবং জয়ী হলেন! মেয়েদের প্রতি বিশ্বাসের সুর বদল হল। আরও নিশ্চিত হল আস্থা।

মানুষের মন জিতে তাঁরা পা রাখলেন পার্লামেন্টে। সেখানে নির্ভীক, সাহসী, যুক্তিনিষ্ঠ এক মহিলার দাপট দেখল তামাম দেশ। তিনি মহুয়া মৈত্র। কৃষ্ণনগরের সাংসদ। সংসদে তাঁর বক্তৃতার পরে অনেকেই যেন বলতে চাইলেন, ‘‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’’
পঞ্চায়েতের অফিসে লোডশেডিংয়ে বন্ধ ফ্যানের তলায় ঘামতে ঘামতে নিজের মোবাইলে মহুয়ার বক্তৃতা শুনল কোনও গ্রামীণ মেয়ে। শুনল আর ভাবল, ‘‘এক দিন আমিও...।’’

ফ্যাসিবাদের কথা বলতে গিয়ে বার বার বাধার মুখে পড়লেন মহুয়া। বক্তব্য মৌলানা আজাদ দিয়ে শুরু করলেন। শেষ করলেন উর্দু কবিকে মনে করিয়ে। একাধিক বার হাউসে শৃঙ্খলা বজায়ের আবেদন জানালেন হাত তুলে। জাত-পাত ভেদাভেদের বাতাবরণকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেলেন। উর্দু কবি রাহাত ইন্দৌরি (কুরেশি)-র ‘অগর খিলাফ হ্যায় হোনে দো’ কবিতার লাইন উদ্ধৃতি করে বললেন, ‘‘কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়?’’ দেশ কারও পিতৃদেবের নয়!

ভোটের আগে অনেকেই বলেছিলেন, ‘‘মানুষ প্রতীকে নয়, মুখশ্রী ও গ্ল্যামারে ভোট দেবে। যদি জেতেন তবে সেটা যোগ্যতার শর্ত নয়। চেহারার জয়।’’ এমন অবৈজ্ঞানিক ও ভিত্তিহীন সমাজ-দর্শনের মুখে ছাই দিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে নজর কাড়লেন বসিরহাটের সাংসদ নুসরত জাহান। প্রচারে সব সময় তিনি মেয়েদের সুরক্ষার কথা বলে এসেছেন। কন্যাশ্রীর পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন। নিজের পোশাকের জন্য ‘ভার্চুয়াল তাড়া’ খেয়েছেন। কিন্তু মুখ খুললেন নির্বাচনী এলাকায় একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের আর্জি জানিয়ে। মনে করিয়ে দিলেন, তিনি কাজ করতে এসেছেন জনগণের স্বার্থেই।

তার পরেও তাঁর বিয়ে, সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেই প্রসঙ্গেও নুসরত টুইটারে জানিয়েছেন নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘‘সকলকে নিয়ে যে ভারত, আমি তার প্রতিনিধি।... যে ভারত জাতপাত-ধর্মের সমস্ত বাধার ঊর্ধ্বে। সব ধর্মকেই আমি শ্রদ্ধা করি। এখনও আমি এক জন মুসলিম। এবং আমি কী পরব, তা নিয়ে কারও মন্তব্য করা উচিত নয়। বিশ্বাসের স্থান পোশাক-সাজসজ্জার উপরে। বিশ্বাসের মানে সব ধর্মের অমূল্য শিক্ষাগুলিকে মনে গ্রহণ করা ও তা পালন করা।’’

রাজনীতির ময়দানে সেই বেঁধে দেওয়া অফ-হোয়াইট শাড়ি ও সাদামাটা ব্যাগ-জুতোর কাহিনিতে ‘ফুলস্টপ’ বসিয়ে নিজের পরিশ্রম করার ক্ষমতা ও যোগ্যতার জয় নিশ্চিত করেন অনেকে। যাদবপুরের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী সেই দলের। প্রার্থী ঘোষণার পরে অনেকেই চমকে উঠেছিলেন, ‘‘যাদবপুর আর মিমি চক্রবর্তী!’’ তবুও আত্মবিশ্বাসে অটল ছিলেন মিমি। বেশ কয়েকটি নির্বাচনী সভা থেকে তিনি বার্তা দিয়েছিলেন, ‘‘আপনাদের জন্যই সিনেমায় আসা। আপনাদের ভালবাসায় রাজনীতির হাত ধরা। আপনারা ভালবাসলেই টিকে থাকব।’’ প্রচারে মাঠে নেমে ফুটবলে পা রেখেছেন। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছেন সভায়। উত্তরবঙ্গ-দিল্লি ভায়া কলকাতা সফরের প্রতিটি ইট নিজের হাতে পেতেছিলেন। তিনি অকুতোভয়। তিনি সফল মডেল। তিনি সফল অভিনেত্রী এবং ফ্যাশন আইকন। রাজনীতির ময়দানে পোশাকের কোনও ‘আনঅফিসিয়াল’ বিধিনিষেধের সামনে তিনি মাথা নত করেননি। পোশাক আসলে
সাচ্ছন্দ্যের জন্য।

কর্মিসভায় দাঁড়িয়ে মিমি বলেছিলেন ‘‘শাড়িতে পা জড়িয়ে পড়লে কি আপনাদের ভাল লাগবে?’’ ভণিতা না করেই জানিয়েছিলেন, ‘‘মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা বলব আবার ভোটপ্রার্থীর ড্রেসকোড নিয়ে মাথা ঘামাব, তা হয় নাকি!’’ সংসদে গিয়ে নিজের নির্বাচনী এলাকায় ওভারব্রিজ ও লেভেল ক্রসিংয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন।

আসলে মেয়েরা যে কিছু করতে পারে তা যেন মেনে নিতে অসুবিধা হয় অনেকেরই। তাই প্রথম থেকেই মেয়েদের উপরে কিছু ভুল তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। আর তাই মেয়েদের ক্ষমতা মুখস্থবিদ্যার নিরিখে বিচার করা হয়। কখনও কারও হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাওয়ার জনশ্রুতি প্রতিষ্ঠা পায়। কখনও পোশাকের ডিজাইন ও মাপে গোটা একটা চরিত্রকে আটকে রাখার চেষ্টা চলে। মেধা নয়, মেয়েদের নেপথ্যে থাকা অদৃশ্য কল্পিত হাতের খোঁজ চলে অবিরাম। চোখ নাচিয়ে দেগে দেওয়া হয়— ‘কার সঙ্গে কার তুলনা! এ সব মেয়েরা দেশের জন্য কী করবে? অমুক না থাকলে কি তমুক মহিলা এই সুযোগ পেতেন?’ এ বার মহিলাদের নিয়ে বাড়তি এবং এলোমেলো কথা বন্ধ হোক। বরং জেগে থাক অগাধ প্রত্যাশা।

নেতা জন্ম নেয়। নেত্রীকে সমাজ নির্মাণ করে। ‘দেখ মেয়ে, যেটা কেউ পারেনি সেটা তুমিই পারবে’— এই নির্মাণের ভিত মহুয়ারা আরও পোক্ত করেন। ভরসা জোগান মিমি, নুসরতেরা। ওঁদের কুর্নিশ।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE