Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের বাঁকুড়া সফর

টমসনের ডাকে সাড়া দেননি। তবে, বাঁকুড়াকে ফিরিয়েও দিতে পারেননি। তাই তো অসুস্থ শরীর নিয়ে জীবনের শেষবেলায় এই জেলায় পদর্পণ করেছিলেন তিনি। তিন দিনের সেই সফর বাঁকুড়াবাসী এখনও ভোলেনি। স্মৃতিপটের সে ছবি ঝালিয়ে নিলেন সৌমেন রক্ষিত টমসনের ডাকে সাড়া দেননি। তবে, বাঁকুড়াকে ফিরিয়েও দিতে পারেননি। তাই তো অসুস্থ শরীর নিয়ে জীবনের শেষবেলায় এই জেলায় পদর্পণ করেছিলেন তিনি। তিন দিনের সেই সফর বাঁকুড়াবাসী এখনও ভোলেনি। স্মৃতিপটের সে ছবি ঝালিয়ে নিলেন সৌমেন রক্ষিত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ১২:০৮
Share: Save:

অভ্যর্থনায় কবির হাতে তুলে দেওয়া হল ফুল-পাতা দিয়ে তৈরি ‘রিথ‌্’। দেখে, তিনি একাধারে স্তম্ভিত এবং ক্ষুণ্ণ। ‘রিথ‌্’ যে মৃতদের সম্মান জানানোর বিদেশি প্রথা, তা এ পর্যন্ত এ দেশের মানুষের অজানা!

তবে এ ঘটনা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁকুড়া ভ্রমণকাহিনির এক সামান্য অংশ মাত্র। বাদবাকি অংশে ভরে রয়েছে বাঁকুড়ার প্রতি তাঁর এবং তাঁর প্রতি বাঁকুড়ার সম্মান ও ভালবাসায়।

১৯৪০ সালের ১ মার্চ রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন বাঁকুড়ায়। থেকেছিলেন দু’দিন। কিন্তু ওই দু’দিনই বাঁকুড়াবাসীর ঝুলি ভরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বাঁকুড়া তখনও এতখানি সহজগম্য নয়। পেরোতে হত দীর্ঘ রাস্তা। তার পরে জলপথ। তার উপরে এখানকার শুষ্ক-রুদ্র রূপ তো তখনও ছিল! সে সব উপেক্ষা করেই শুধুমাত্র এই ভূম এবং এখানকার মানুষকে সম্মান জানিয়ে অসুস্থ কবি বাঁকুড়ায় এসেছিলেন।

প্রথম দিন অর্থাৎ, ১ মার্চ, বেলা ১২টা নাগাদ বাঁকুড়ার মেজিয়াঘাটে উপস্থিত হলেন কবি। এলেন সদলবলে। সঙ্গে ছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা ঠাকুর, চিকিৎসক অমিয় চক্রবর্তী, সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, অনিলকুমার চন্দ প্রমুখ। বোলপুর থেকে খানা জংশন পর্যন্ত এসেছিলেন রেলপথে। সেখান থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত মোটর গাড়িতে। তারপরে সেই গাড়িটিকে নৌকায় করে পার করানো হয় দামোদর নদ।

দামোদরের তীরে অবশ্য কবিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পার্বতীচরণ সেন, দর্শনের অধ্যাপক শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। অসুস্থ কবি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পেরোলেন দামোদরের চর। মেজিয়াঘাটে তখন সেই প্রখর তাপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে শতাধিক মানুষ। মেজিয়া থেকে বাঁকুড়া শহর পর্যন্ত রাস্তার ধারে প্রচুর লোকের সমাগম ও জয়ধ্বনি সে দিন বাঁকুড়া জেলাকে আলোড়িত করেছিল।

সে দিন বেলা দেড়টা নাগাদ কবির গাড়ি এসে পৌঁছয় গন্ধেশ্বরী নদীর ঘাটের কাছে। আগে থেকেই কবির থাকার জায়গা স্থির করা ছিল। উঠলেন ‘হিল হাউস’-এ। বিকেল ৪টে নাগাদ ‘বাঁকুড়া নারী-সমিতি ও শিশুমঙ্গল সমিতি’র সদস্যেরা কবিকে সেখানেই অভ্যর্থনা জানালেন। যাঁর আহ্বানে কবি বাঁকুড়া এসেছিলেন, সেই ঊষা হালদার সে দিন কবি-প্রশস্তি পাঠ ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

২ মার্চ সকালে নবনির্মিত চণ্ডীদাস অভিনয় গৃহে কবির অভ্যর্থনায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে একে-একে অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন বাঁকুড়া পুরসভার তৎকালীন সভাপতি হরিসাধন দত্ত, বাঁকুড়ার জনগণের পক্ষ থেকে ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অভ্যর্থনা সমিতি’র সভাপতি তথা ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঁকুড়া সাহিত্য পরিষদ’-এর পক্ষে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বাঁকুড়া শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং বিষ্ণুপুরবাসীর পক্ষ থেকে নরেন্দ্রনাথ কর। নরেন্দ্রনাথবাবু সেদিন কবির হাতে তুলে দেন একটি সুন্দর নকশা-করা শঙ্খ।

তবে সে দিন কবিকে পাতা ও ফুল দিয়ে তৈরি করা ‘রিথ্‌’ দেওয়া হলে কবি অসন্তুষ্ট হন। জানান, এ সব তো বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রথা। আবার জানান, মানপত্র পাঠ শেষে শ্রোতাদের হাততালি দেওয়াও বিদেশি প্রথা। শান্তিনিকেতনে সে সব তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সে দিন প্রায় চল্লিশ মিনিট অনেক কথা বলেন তাঁর বক্তৃতায়। সেখানে তিনি বলেন— ‘‘এই তো একটা জায়গায় এলুম, বাঁকুড়ায়। প্রাদেশিক শহর বটে কিন্তু পল্লিগ্রামের চেহারা এর। পল্লিগ্রামের আকর্ষণ রয়েছে এর মধ্যে। সাবেক দিন থাকত তো এরই আঙিনায় আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে পারতুম।’’ আবৃত্তি করেন ‘ফাঁকি’ কবিতাটি। ভাষণে তিনি বাঁকুড়ার সাধক কবি চণ্ডীদাসের কথা বলেন। আর শেষে বলেন, “তোমাদের অভিনন্দনকে আজ আমি গ্রহণ করি, আপাতত এ জমা থাক্‌ গচ্ছিত সম্পত্তির মতো, কালের অভিনন্দন সভায় এর যাচাই হবে, তখন তোমাদের এই বাঁকুড়াতেই চণ্ডীদাসের পাশে কী আসন পাব—এই প্রশ্ন মনে নিয়ে বিদায় গ্রহণ করি।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সে দিন বিকেলে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ‘হিল হাউস’-এ কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যেহেতু তাঁদের মধ্যে ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা বেশি ছিল, তাই তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং লোকশিক্ষা সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। কবির মতে, প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে শিক্ষা হওয়া কাম্য নয়। কারণ, প্রকৃতি মানুষের মনে ও শরীরে সজীবতা আনে। প্রাচীনকালে তাই অরণ্যের মাঝে শিক্ষা গ্রহণ-বিতরণ চলত শিষ্য ও গুরুর মধ্যে। একই সঙ্গে জানান, যাত্রাগান, বাউল, কথকতা যাতে লোপ না পায়, সে দিকে সবাইকে মনযোগী ও আগ্রহী হতে হবে।

৩ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ‘বাঁকুড়া নারী ও শিশুমঙ্গল সমিতি’র প্রসূতি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটি বাঁকুড়া জেলা স্কুলের পূর্ব দিকে অবস্থিত। মূলত ভবন উদ্বোধনের জন্যই কবির বাঁকুড়ায় আসা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে গাড়ি থেকে নামতে নিষেধ করেন অনেকে। তিনি শোনেননি। বলেন, “এখানে যে কয়টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি—এইটি হচ্ছে সবচেয়ে আনন্দজনক অনুষ্ঠান। আমি যদি গাড়িতে বসে এই অনুষ্ঠানের কাজ করি তবে সেটা মাতৃজাতির প্রতি উপেক্ষাই প্রকাশ পাবে। শারীরিক ক্লান্তি তো এ বয়সে থাকবেই—কিন্তু বিবেকের কাছে আমি অপরাধী হতে চাই না।”

এখান থেকে তিনি ‘অভিনয় গৃহ’-এ যান বর্তমানে যেখানে চণ্ডীদাস চিত্রমন্দির (বর্তমানে বন্ধ) স্থাপিত। বাঁকুড়া জেলার ছাত্রসমাজ সেখানে কবিকে অভ্যর্থনা জানান। ছাত্রসমাজের পক্ষে উমা দেবী অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। এটি লিখেছিলেন অশোকানন্দ বসু। বিকেলে কবিকে দেখার জন্য ‘হিল হাউস’-এর মাঠে অগণিত মানুষ জড়ো হন। সে দিন সন্ধ্যায় অভিনয় গৃহে ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়। সেটি দেখে রবীন্দ্রনাথ রাত ১১টা নাগাদ বেঙ্গল নাগপুর রেলযোগে কলকাতা যাত্রা করেন।

তথ্য সূত্র: রবি দত্ত। রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী।

লেখক সিমলাপাল মদন মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE