Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শরতের মনকেমনে উঁকি দেয় কিছু প্রশ্নও

স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে চেয়ে থাকে শুধু বোবা রোদ্দুরের টিপ। এ ভাবেই পেরিয়ে যায় জীবনের কত মধুমাস! লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্যমনই কোনও এক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আলো-আঁধারের মায়াবী ভোরে আচ্ছন্ন বাঙালি সমাজের মন্ত্রমুগ্ধতার সুযোগে ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’ চেয়ে ফেলেছিলাম তাঁর কাজল কালো চোখে, ছুঁয়ে ফেলেছিলাম তাঁর রাঙা হাতখানি। ‘সে আজিকে হল কতকাল, মনে হয় যেন সেদিন সকাল!’ 

স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে চেয়ে থাকে শুধু বোবা রোদ্দুরের টিপ। ফাইল চিত্র।

স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে চেয়ে থাকে শুধু বোবা রোদ্দুরের টিপ। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:২৪
Share: Save:

‘বধুঁয়া আমার চোখে জল এনেছে’ সেই কোন কাকভোরে! তখন সবেমাত্র কৈশোরের কলকাকলি পেরিয়ে যৌবনের ঝোপঝাড়ে উঁকি মারার মহাসন্ধিক্ষণ। এমনই কোনও এক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আলো-আঁধারের মায়াবী ভোরে আচ্ছন্ন বাঙালি সমাজের মন্ত্রমুগ্ধতার সুযোগে ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’ চেয়ে ফেলেছিলাম তাঁর কাজল কালো চোখে, ছুঁয়ে ফেলেছিলাম তাঁর রাঙা হাতখানি। ‘সে আজিকে হল কতকাল, মনে হয় যেন সেদিন সকাল!’

তার পরে কত আগমনী অমানিশা, কত কোজাগরী জ্যোৎস্না পার হয়ে জীবনের বৃত্ত চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে আজ আমি চুল্লির আলোর দিকে কয়েক কদম এগিয়ে। আজ বীরেন্দ্র কৃষ্ণের তন্দ্রাচ্ছন্ন কাকভোরে যখনই কানে ভেসে আসে সেই মন্ত্র, তখনই স্মৃতির মরচে ধরা টিনের বাক্স ভেঙে চুরমার করে ছিটকে পড়ে তাঁরা, আমার কাঁচা বয়সের শিউলি বিছানো ভোরের আদর, আমার শিশির মাখা যৌবনের উদ্দাম উতলা শরৎ, আমার প্রথম ভালোলাগার ঝিলিক লাগানো জ্যোৎস্নার চাদর।

কবেকার সেই আতস চোখ আজও খুঁজে বেড়ায় শুধু সেই আকুতি মাখা চোখ দু’টি, এক দিন যে চোখ আমায় শিখিয়েছিল আগমনীর বোলে নাচতে, শারদ প্রান্তরে থরে থরে ফুটে থাকা কাশফুলের অন্তরের দোলায় দুলতে, মনখারাপের বিসর্জনের বিকেলে উদাত্ত কণ্ঠে রবি বাউলের গান গাইতে।

তখন বোধগম্যতা ছিল সীমাবদ্ধতায় বিদ্ধ। তখন সংস্কৃত মন্ত্রের নির্যাস নিয়ে এতটুকুও মাথাব্যথা ছিল না। তখন দুর্গাপুজোর গূঢ় দর্শন-তত্ত্ব বোধগম্যতার নাগালের থেকে সহস্র যোজন দূরে। কিন্তু সেই কাঁচা বয়সের টগবগে হৃদয় পেতে জীবন থেকে যা কিছু নিতে পেরেছি, সেই সঞ্চয়ের স্মৃতির জাবর কেটেই তো এই বয়েসে এক্কাদোক্কা করে এগিয়ে চলেছি জীবনপথের ইতিহাসের এক পাতা থেকে অন্য পাতায়। ধাবমান গতির আবর্তনে ক্রমশই ফিকে হয়ে আসে ঝকমকে আলোয় মাখা চকচকে মুহূর্তের আলিঙ্গন। মুহূর্তদের হেলায় হারিয়ে ফেলি আমরা, যতক্ষণ না তাঁরা স্মৃতির আকুতি নিয়ে ফিরে ফিরে আসে তোলপাড় করা বক্ষমাঝে। বয়ে নিয়ে চলি আমরা, সন্তাপের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের ফল্গুধারা, জীবনের প্রতিটি আঁকেবাঁকে। ঝলসে যাওয়া মুহূর্তের অস্থিভস্মে চলকে ওঠে হৃদয়কুম্ভ কানায় কানায়।

স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে চেয়ে থাকে শুধু বোবা রোদ্দুরের টিপ। এমনি ভাবেই পেরিয়ে চলে যায় জীবনের কত মধুমাস! তবুও জীবনের পথে কোথাও হোঁচট খেলেই আজও হাতড়ে বেড়াই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মন্ত্রোচ্চারণের ছটায় উদ্ভাসিত সেই কাকভোরগুলি, শরতের মনকেমনের বাঁশির মূর্ছনায় মুখরিত সেই অলস দুপুরগুলি, কাশবনের কাঁপনের আড়ালে চোখে চোখ রাখা সেই
হলুদ বিকেলগুলি।

জীবনের পাকদণ্ডী পথের চড়াই-উৎরাই পেরোতে আজও আলোর দিশা দেখায় ছেলেবেলার সেই মহালয়ার ভোরে ছুঁয়ে ফেলা রাঙা হাত দু’টি, চোখে চোখ রাখা সেই কাজল কালো চোখ। জীবন আমাদের নিরন্তর সাক্ষী রেখে বয়ে চলেছে ঘটনাবহুল জীবনতরঙ্গের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, স্মৃতি উস্কে দিয়ে। প্রতিনিয়ত। ফেলে আসা পথের ধুলো লণ্ডভণ্ড করে দেয় আমাদের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের সাধের কল্পনার রঙে তিলতিল করে আঁকা রঙিন আলপনাগুলো।

মহালয়ার মনকেমনের ভোর আসার কয়েক দিন আগে থেকেই রাতে বিছানায় শুয়ে অশীতিপর ঠাকুমার মুখে শুনতাম স্বর্গলোকের গল্প, দুর্গা সৃষ্টির গল্প, দুর্গার মহিষাসুর বধের গল্প, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের ‘দেশের বাড়ির’ অনাড়ম্বর দুর্গাপূজোর গল্প। সে দিনের সেই শিশুমন এক বারের জন্যেও প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি, মা দুর্গা কেন মহিষাসুরকে বধ করে শায়েস্তা করলেন? কেনই বা তিনি দুষ্টের দমনে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে বিকল্প কোনও পথের দিশা দেখাতে পারলেন না? এক অসুরকে শুধুমাত্র হত্যা করেই কি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমগ্র পাশবিক প্রবৃত্তিকে দমন করা সম্ভব? কেনই বা সকল দেবতাদের বলে বিপুল বলীয়সী দুর্গা মহিষাসুরের ‘অসুর মনের’ পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো পরিবর্তন করতে অসমর্থ হলেন?

নাকি তার কোনও চেষ্টাই তিনি করেননি? সেই চেষ্টা না করার নেপথ্যে কী কী কারণ ছিল? দুর্গার কাছে অসীম শক্তি আর বিপুল অস্ত্রসম্ভারের প্রত্যয়েই কি তিনি ওই পথে হাঁটেননি? যার কাছে ক্ষমতা থাকে, শক্তি থাকে, অস্ত্র থাকে, তিনি কি ক্ষমতা, শক্তি আর অস্ত্রের ভাষাতেই জবাব দিতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? পৃথিবীর তথাকথিত ‘সভ্য’ মানবসমাজ আর স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে কি অনেক মিল রয়েছে?

যারা শাসকের পরিবর্তন চান, তাঁরা হয়তো এই সিস্টেমে টিকে যান। কিন্তু যাঁরা এই সিস্টেমের পরিবর্তন চান, তাঁদের কি এই মহাশক্তিধর সিস্টেম এ ভাবেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়? ক্ষমতার দম্ভের ঔদ্ধত্যে, শক্তির আস্ফালনের স্পর্ধায়, অস্ত্রসম্ভারের ঝলকানির মত্ততায়! যাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হন, তাঁদেরও এই একই ভাবে দমন করার রীতি কি স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত? ক্ষমতা, শক্তি আর অস্ত্রের দর্পে মানবসমাজের মনন থেকে কি ক্রমেই বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে মানবতার নিষ্কলুষ মন্ত্রোচ্চারণ! বঞ্চনা, হাহাকার, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ কি যুগ যুগ ধরে অবদমিত হয়েই থেকে যাবে উদ্যত মারণাস্ত্রের উদ্ধত স্পর্ধার কাছে!

লেখক: শিক্ষক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mahalaya Mahisasurmardini
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE