বিবেকানন্দ তখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পিতা বিশ্বনাথ দত্তকে নাকি তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বাবা, আমাদের জন্য আপনি কী রেখে গেলেন?” আইনজীবী পিতা উত্তর দিয়েছিলেন, “আয়নার সামনে গিয়ে দেখো, বুঝতে পারবে।” এ-ঘটনা উনিশ শতকের ডাকসাইটে বাঙালি যুবার জীবনের পাথুরে সত্য কি না, সে বিচার থাক। মনীষীদের নিয়ে নানা কথা বাঙালির স্মৃতি-শ্রুতিতে বয়ে চলে, এ-ও হয়তো তেমন। তবে ঘটনাটি গভীরতর তাৎপর্যে ব্যবহার করা সম্ভব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী করি আমরা? নিজেকে দেখে মগ্ন হতে পারি, যাকে বলে নার্সিসাস কমপ্লেক্সের হদ্দমুদ্দ। ১৯২০ নাগাদ আমেরিকান জার্নাল অব সাইকলজি-তে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারে আলোচনা শুরু হয়েছিল। বিবেকানন্দের তখন প্রয়াণ হয়েছে। তবে আত্মরতির এই প্রবণতা তো অচেনা নয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর একটি কাজও করতে পারি আমরা, নিজের বিচার করতে পারি। আমি কে? কী আমার সামর্থ্য! কোথায় আমার সীমাবদ্ধতা। সেই সীমাবদ্ধতাকে কি অতিক্রম করা সম্ভব? এ যেন নিজেকে জানা, নিজেকে জেনে নিজের অস্তিত্বের সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতাকে বুঝে নিজের সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠা। শ্রদ্ধাযুক্ত মানুষ সপ্রত্যয়ে স্থিত।
রূপকথার সেই হিংসুটে রানি রোজ আয়নাকে জিজ্ঞাসা করত, “জগতের সবচেয়ে সুন্দরী কে?” আয়না অন্য কারও নাম বললেই সে হিংসেয় জ্বলে পুড়ে খাক। তার চেয়ে সুন্দরী কেউ হতেই পারে না। যদি হয় তা হলে সে নিকেশ করবে তাকে, বিষ খাওয়াবে। এই আত্মরতি মানুষকে সঙ্কীর্ণ করে, হিংসুটে উন্মাদবৎ করে তোলে। এই আত্মরতি সামূহিক ভাবে উদগ্র দেশপ্রেমীদের যুদ্ধবাজ করে তোলে, এই আত্মরতি সামূহিক ভাবে ধর্মোন্মাদদের সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। এই আত্মরতি আসলে নিজের সম্পর্কে এক রকম নিরাপত্তাহীন হীনতার বোধ থেকে জেগে ওঠে। সবাই অবশ্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মৌতাতে মগ্ন হন না। একটু দূর থেকে নিজেকে দেখেন, নিজের সামর্থ্য বিচার করেন। তার পর যা ভাবেন তা সেই নচিকেতার কথা।
নচিকেতার গল্প আছে কঠোপনিষদে। সে গল্প বিবেকানন্দের বড় প্রিয় ছিল। নচিকেতার বাবা যজ্ঞ করছেন, দান করছেন ব্রাহ্মণদের। তবে দানের সেই গরুগুলি আর ঘাসও খাবে না, দুধও দেবে না। অথচ, বাবার দাতা হিসেবে নাম হবে। পিতার এই ‘অনাচার’ দেখে বিরক্ত নচিকেতা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আমাকে কার কাছে দান করলেন?” ছেলের এই প্রশ্নশীলতায় তিনি বিরক্ত, জবাবই দেননি প্রথমে। তবে ছেলেও ছাড়ার পাত্র নন। ক্রমাগত সেই একই প্রশ্ন। শেষে বিরক্ত হয়ে বাবা বললেন, “তোমাকে যমের কাছে দান করলাম।” সচরাচর মৃত্যু-দেবতা যমকে আমরা পছন্দ করি না বলে সবচেয়ে খারাপ জিনিসই দেওয়া হয় তাঁকে। নচিকেতা ভাবতে বসলেন, “পিতা কেন আমাকে যমের হাতে দিতে চান? আমি তো জগতের সবচেয়ে খারাপ নই, সকলের চেয়ে ভাল আমি না হতে পারি, কিন্তু সকলের চেয়ে খারাপ আমি কিছুতেই নই।” এই ভাবনাকে বলা চলে শ্রদ্ধাশীলতা।