Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হেইডেলবের্গের বিদ্যা সম্পত্তিতে উত্তরবঙ্গের আমারও অধিকার ছিল

বিমূর্ত ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি বিস্তৃতি আর বিশালত্বের কথা। লিখছেন পিনাকী রায়সমগ্র জার্মানির–জার্মান জাতির– ইতিহাস জুড়ে শুধু যুদ্ধের বাতাবরণ। সেই প্রাচীন কালে রোমান আর (ফরাসি) গলদের বিপক্ষে আমৃত্যু সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল গথেরা।

হেইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়।

হেইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়।

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৯ ০১:৩২
Share: Save:

অলটে ব্রুয়েক-এর এক ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত ‘হেইডেলবের্গ ব্রিজ মাঙ্কি’–ব্রুয়েকেনাফে। তার হাতে একটি আয়না। ব্যারক-যুগের কবি মার্টিন জেইলার-এর লেখনীতে সমগ্র ইউরোপে খ্যাতি লাভ করা এই সেতু-বানরকে স্পর্শ করলে নাকি সৌভাগ্যের আধিকারী হওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের নানা বিশ্বাস নিয়ে আমিও ছুঁয়ে দেখলাম। হয়তো, এর ফলে, দুই-এক দিন পরেই জুটে গেল এক সিরীয় সুন্দরীর সঙ্গে ‘রাজা-রানি রেস্টুরেন্ট’-এ মধ্যাহ্নভোজ!
সমগ্র জার্মানির–জার্মান জাতির– ইতিহাস জুড়ে শুধু যুদ্ধের বাতাবরণ। সেই প্রাচীন কালে রোমান আর (ফরাসি) গলদের বিপক্ষে আমৃত্যু সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল গথেরা। মানে, পূর্ববর্তী জার্মানরা। পরবর্তী দুই হাজার বছরে–দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত –সেই রণধারা বজিয়ে থেকেছে। হিটলার যখন জার্মানিতে নিজের প্রভাব বিস্তার করছিলেন, হেইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-ছাত্ররা নাৎসি নীতিকে প্রবল ভাবে সমর্থন করেছিলেন –১৯৩৩-এর পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন বহু বিদগ্ধ, তথাকথিত ‘নন-নর্ডিক’ অধ্যাপকেরা। ১৯৩৪ আর ১৯৩৫ সালে ‘রাইখসআরবাইটেসডেনিস্ত’ (রাষ্ট্রীয় শ্রম-বিভাগ) আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-ছাত্ররা মিলে স্থপতিকার হেরমান আলকেরের তত্ত্বাবধানে হেইডেলবের্গের অদূরে হেইলেইজেনবের্গ পাহাড়ের উপর তৈরি করেন ‘হেইডেলবের্গ থিংস্ট্যাটে’-মুক্তমঞ্চ। আমার শিক্ষক, আধ্যাপক স্নিরের ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ‘ব্ল্যাক ফরেস্ট’-এর একটি ‘এক্সটেন্সান’-এর মধ্যে অবস্থিত ২০,০০০ মানুষের ব্যবহারযোগ্য এই সুবিশাল ‘হেইডেলবের্গ থিংস্ট্যাটে’-তে। অবাক হয়ে দেখছিলাম বিশালত্বের প্রতি নাৎসিদের তীব্র আকর্ষণের উৎকৃষ্ট এই নমুনা। যেন চিলাপাতা বনের গভীরে নল রাজার গড়। শুধু সম্পূর্ণ ভাবে অক্ষত। রক্তাক্ত এক অতীতের সাক্ষী হিসাবে। চারিদিকে ছড়িয়ে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে ইউরোপীয় কেল্টসদের তৈরি প্রাচীন দেওয়ালগুলির ধ্বংসাবশেষ। এক সঙ্গে রয়েছে হেইলেইজেনবের্গের অংশ মিসেলবের্গ পাহাড়ে ‘হেইলেইজেনবের্গট্রুম টাওয়ার’। আর রয়েছে থিংস্ট্যাটের থেকে আরও খানিকটা পাহাড়ের ওপরে উঠে ‘সন্ত মাইকেলের মঠ’– খ্রিস্টাব্দ ১০২৩-এ তৈরি–একটি রোমান মার্কারি-মন্দিরের কাঠামোর উপর। বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বিমূর্ত ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি এর বিস্তৃতি আর বিশালত্বের কথা। পাশে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক স্নিরের নিশ্চুপ।
মনে ভাবছিলাম, সাহিত্যতত্ত্বের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক থাকে। তবে সেই সঙ্গেই এও তো ঠিক যে, অনেক সময় সেই ইতিহাসটি পরে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, আর তাতেই যেন মুক্তি ঘটে তত্ত্বটির। তখন তা সারা পৃথিবীর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। যেমন ধরা যাক, আমি ইংরেজির ছাত্র। আমি শেক্সপিয়র পড়েছি। আমি জানি, শেক্সপিয়র তাঁর সম সময়ের নানা ঘটনার অভিঘাত নাটকে ধরেছিলেন। কিন্তু সেই ঘটনাগুলো যদি কেউ মনে না-ও রাখেন, তা হলেও তিনি শেক্সপিয়র পড়তে পারেন। তিনি তাঁর মতো ব্যাখ্যাও করতে পারেন। তাই নাৎসি জার্মানির কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব রহিত জীবনেও হেইডেলবার্গের এই বিদ্যা সম্পত্তির সঙ্গে সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে এসে আমার সম্পর্ক গড়তে দেরি হল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে –১২ নম্বর কেটেনগেসেতে –আমরা পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি প্রাণপণে। আর মন-প্রাণ ভরে উপলব্ধি করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনত্বের, এর ঐতিহ্যের, আর এর ‘এক্সসেলেন্ট একাডেমিক অ্যাটমস্ফেয়ার’-এর। সুবিশাল গ্রন্থাগারগুলি–প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব গ্রন্থাগার রয়েছে; সঙ্গে রয়েছে কেন্দ্রীয় ‘ইউনিভার্সিটাট বিবলিওথেকে’। লক্ষ লক্ষ বইয়ের সমাহার। অবশ্য, আশি বছর আগে, এমনিই একটি পরিবেশে শুরু হয়েছিলো নাৎসি বাহিনির হানা– শহরের ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষদের উপর। ২২ অক্টোবর ১৯৪০-তে শহরের ৬,০০০ ইহুদিকে দক্ষিণ ফ্রান্সের ‘গিরস’ বন্দিশালায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মৃত্যু হয় বহু মানুষের। হয়তো আজও হেইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে-কানাচে – নেকার নদীর ধারে, বিসমার্কপ্লাজ, বা ক্যাম্পাস বের্গহেইমে সেই দীর্ঘশ্বাস রয়ে গিয়েছে।
অথচ এক সময় এই শহরের অঞ্চলেই শুরু হয়েছিল মানবজাতির ইতিহাসের একটি পাতার– ১৯০৭ সালে আনুমানিক ৬,০০,০০০ বছরের পুরানো ‘হেইডেলবের্গ ম্যান’-এর চোয়ালের হাড় উদ্ধার করেন জার্মান জীবাশ্মবিদেরা। আনুমানিক খ্রিস্টাব্দ ৫০ থেকে ২৬০ অবধি হেইডেলবের্গ ছিল রোমানদের দখলে। পরে, জার্মান জনজাতিরা অঞ্চলটিকে পুনরুদ্ধার করেন ও খ্রিস্টাব্দ ৮৫০ নাগাদ অঞ্চলের বেশিরভাগ বাসিন্দারাই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। একদা ‘হোলি রোমান এম্পায়ার’-এর অংশ এই হেইডেলবের্গ ১১৫৫ সাল সময় থেকে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়। পরে বারবার প্রতিবেশী ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেছে এই অঞ্চলটি। গ্রন্থাগারের ইতিহাস-বইগুলি পড়ে জানতে পেরেছি হেইডেলবের্গের সেই রক্তমাখা গল্প। ফিউনিকুলার ট্রেনে করে বেড়িয়ে এসেছি ‘হেইডেলবের্গার স্লস’ (বা সুবিশাল ‘হেইডেলবের্গ দুর্গ’)। ১২১৪-তে স্থাপিত। রাজা প্রথম লুডুইগ-এর সময়। সেপ্টেম্বর ১৬৮৮ থেকে মার্চ ১৬৮৯ অবধি ফরাসিদের দখলে ছিল সমগ্র হেইডেলবের্গ। ফরাসিরাই ‘হেইডেলবের্গ দুর্গ’-কে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। যদিও তারা সমর্থ হয়নি।
কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে; কখনও পার্টিগুলিতে; কখনও গ্রন্থাগারে বুঝিয়েছি, হেইডেলবের্গ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ম্যানহেইম বা নেকারগ্যামুএন্ড সুন্দর হতেই পারে; উত্তরও কিন্তু কম যায় না।


(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Heidelberg University Goth Germany
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE