Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

শাস্তি কেন

বিনামূল্যে শিক্ষা, মিড-ডে মিল ইত্যাদি সুবিধার লোভও যখন দেশের সব শিশুকে স্কুলে আনিতে পারে নাই, তখন শাস্তির খাঁড়াই একমাত্র পন্থা হিসাবে বিবেচিত হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৪
Share: Save:

ছেলেমেয়েকে স্কুলে না পাঠাইলে অভিভাবকদের শাস্তি হইবে, এই মর্মেই দেশের স্কুলশিক্ষা বিষয়ক সর্বোচ্চ সংস্থা সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসারি বোর্ড অব এডুকেশন প্রস্তাব করিল। শিক্ষার অধিকার আইনে সংস্কার হইবে, তাহাতেই এই পরিবর্তনটি জুড়িয়া দেওয়ার প্রস্তাব। অন্তর্নিহিত যুক্তিটিকে দুই স্তরে বোঝা সম্ভব। এক, শিক্ষা যেহেতু প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত, কোনও অভিভাবক যদি তাঁহার সন্তানকে সেই অধিকার হইতে বঞ্চিত করেন, তবে এক জন নাগরিককে তাহার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিবার ‘অপরাধে’ সেই অভিভাবককে শাস্তি দেওয়া চলে। ইহা দার্শনিক যুক্তি। দ্বিতীয় যুক্তিটি ব্যবহারিক— শাস্তির ভয়ে অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে পাঠাইবেন। বিনামূল্যে শিক্ষা, মিড-ডে মিল ইত্যাদি সুবিধার লোভও যখন দেশের সব শিশুকে স্কুলে আনিতে পারে নাই, তখন শাস্তির খাঁড়াই একমাত্র পন্থা হিসাবে বিবেচিত হইয়াছে।

এই বিধানেও কাজ হইবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে হইলে প্রথমে জানা দরকার, যাঁহারা সন্তানকে স্কুলে পাঠান না, অথবা স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ হইবার পূর্বেই ছাড়াইয়া লন, তাঁহারা সেই সিদ্ধান্তটি করেন কেন? সাম্প্রতিক বহু গবেষণা, সমীক্ষা এবং সংবাদ প্রতিবেদনে স্পষ্ট, একেবারে অক্ষরজ্ঞানহীন, হতদরিদ্র অভিভাবকরাও এখন শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন। তাঁহারা জানেন, সন্তান একটি বাড়তি বৎসর স্কুলে কাটাইলে তাহার গোটা জীবনের উৎপাদনশীলতা এবং উপার্জনক্ষমতা অনুপাতের তুলনায় বেশি হারে বাড়িবে। অতএব, পড়াইয়া লাভ নাই ভাবিয়া সন্তানকে স্কুলে পাঠান না, এমন পিতামাতার সংখ্যা এখন নগণ্য। সিদ্ধান্তটির পিছনে বাধ্যবাধকতা থাকে। খাতায়কলমে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু বহু দরিদ্র পরিবারেই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানও উপার্জনশীল সদস্য। কেহ বাহিরে কাজ করে, কেহ পারিবারিক পরিসরেই খাটে। কন্যাসন্তানের উপর অনুজদের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে, মাকে কাজে বাহির হইতে হইলে পরিবারের দায়িত্বও তাহাকেই সামলাইতে হয়। শিক্ষার উপযোগিতা বিষয়ে সচেতনতার ক্ষেত্রেও লিঙ্গবৈষম্য আছে ঠিকই, কিন্তু পুত্রের ক্ষেত্রে তো বটেই, কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ অভিভাবকই জানেন, স্কুলে না পাঠাইয়া তাঁহারা কাজটি ভাল করিতেছেন না। কিন্তু, বর্তমানের প্রয়োজনের নিকট ভবিষ্যতের লাভকে হার মানিতেই হয়।

অভিভাবকদের শাস্তির ব্যবস্থা হইলেই কি ছবিটি পালটাইবে? তাঁহারা এই সমস্যাগুলিকে অতিক্রম করিবার উপায় এবং শক্তি খুঁজিয়া পাইবেন? না কি, কিছু খুচরা আধিকারিকের দুর্নীতির আর একটি রাস্তা খুলিয়া যাইবে— তাঁহারা অশিক্ষিত অভিভাবকদের ভয় দেখাইয়া কিছু টাকা অথবা কলা-মুলা আদায় করিয়া লইবেন? দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই জোরদার। শিক্ষার অধিকারকে যদি সত্যই সকল শিশুর নাগালে আনিতে হয়, তবে তাহা ভয় দেখাইয়া, রাষ্ট্রীয় গা-জোয়ারির পথে হইবে না। অবশ্য, নরেন্দ্র মোদীর আমলে এই গা-জোয়ারিই দস্তুর— রেশন কার্ডের সহিত আধারের লিংক না করানো হইলে এই আমলে গরিবের খাওয়া বন্ধ হয়। ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাইবার পথে অভিভাবকদের সম্মুখে যে বাধাগুলি রহিয়াছে— মূলত অর্থনৈতিক বাধা— তাহা দূর করিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সেই ব্যবস্থাগুলিকে সন্তানের শিক্ষার সহিত ইতিবাচক প্রণোদনা হিসাবে কী ভাবে জুড়িয়া দেওয়া যায়, তাহা ভাবা প্রয়োজন। যেমন, সন্তানের স্কুলে উপস্থিতির হার ৯০ শতাংশের বেশি হইলে পুরস্কার বাবদ কিছু টাকা দেওয়া যায় কি না, বা স্কুলছাত্রীদের ছোট ভাইবোনদের জন্য প্লে-স্কুল গোত্রের কিছু ব্যবস্থা করা যায় কি না, ভাবিয়া দেখা যায়। অভিভাবকদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবিয়া সুবিধা হইবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

School Students Guardians Punishment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE