অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার কতটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে, আঁচ পেলাম আমরা। প্রতীকী ছবি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অনেক এগিয়েছি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অনেক প্রগতি এসেছে সমাজে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা আঁধার দিনগুলোকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু আচমকা যাবতীয় প্রগতির সংহার ঘটে যায়। আচমকা দেখতে হয়, পাশের পাড়ায় ‘ডাকিনী’ গুজব ছড়িয়ে পড়েছে অবাধে বা দূরের গ্রামে ‘ভূতে ধরা’ নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে বা সুদূর কোনও প্রান্তে সর্পদষ্ট মরণাপন্নকে ওঝার হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। রোজ হয়ত ঘটে না এ সব ঘটনা, যত্রতত্র হয়ত ঘটে না। কিন্তু যে দিনই ঘটে, যে প্রান্তেই ঘটে, কালি লেপে দিয়ে যায় আমাদের সবার মুখে।
সমাজের উপরের স্তরের ঔজ্জ্বল্য দেখে যদি সমাজের প্রগতি মাপার চেষ্টা হয়, তা হলে সে পরিমাপে বিভ্রম থেকে যায়। সমাজের প্রকৃত প্রগতি মাপা যায় তার নীচের স্তরের অগ্রগতি পরখ করে। অপারগতায়, প্রতিকূলতায়, সীমাবদ্ধতায় যাপন যাঁদের রোজ, তাঁদের ঘর-দুয়ার কতটা আলোকিত? দেখতে হবে প্রগতি বুঝতে। পূর্ব বর্ধমান জেলার রায়না ব্লকের বাথানডাঙা গ্রাম বুঝিয়ে দিল, আলো এখনও সর্বত্রগামী হয়ে উঠতে পারেনি আমাদের সমাজে। নিকষ অন্ধকার এখনও জমাট আমাদের আশেপাশেই।
‘ভূতে পেয়েছে’ গ্রামের মহিলাদের, একে একে ‘ভূতে পাচ্ছে’, মহিলাদেরই ‘ভূতে পাচ্ছে’— বাথানডাঙায় বিশ্বাস দৃঢ়মূল হল। কী ভাবে বোঝা গেল ‘ভূতে পাচ্ছে’ সকলকে? একে একে অনেক মহিলার জ্বর হল বা অন্যতর অসুস্থতা দেখা দিল। ‘ভূতে পাওয়া’র বা অসুস্থ হওয়ার কারণ কী? বাথানডাঙা চিহ্নিত করল গ্রামেরই এক মহিলাকে। নিকটবর্তী অন্য একটি গ্রামে এক ওঝার কাছে গিয়ে ‘অপবিদ্যা’ শিখেছেন ওই মহিলা— স্থির বিশ্বাসে উপনীত হলেন গ্রামবাসীরা। ‘অপবিদ্যা’র প্রয়োগেই একে একে অসুস্থ অন্য মহিলারা— নিশ্চিত হয়ে গেল গ্রাম।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
অতএব গ্রামে ওঝা ডাকা হল, ‘অপবিদ্যার সাধিকা’র বাড়ি ঘিরে ফেলা হল, হামলা হল, ‘ভূত নামানো’ হল, অন্য মহিলাদের ঘাড় থেকেও ‘ভূত নামানো’র দাবি তোলা হল, রাজি না হওয়ায় ওঝা আক্রান্ত হলেন, গোলমালের খবর পেয়ে পুলিশ গেল, পুলিশও আক্রমণের শিকার হল।
আরও পড়ুন
ডজনখানেক ‘ভূত’ নিয়ে জেরবার, তাড়াতে রাজি না হওয়ায় ওঝাকেই মার
অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার কতটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে, আঁচ পেলাম আমরা। অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের অস্তিত্ব এতখানি প্রবল হতে পারে আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় আজও, দেখলাম প্রত্যেকে।
স্বচ্ছ সমাজ আসলে খাঁটি দুধের মতো স্পর্শকাতর একটা অস্তিত্ব। এক বিন্দু গোমূত্রে যেমন বিনষ্ট হয় দুধে পরিপূর্ণ পাত্রটা, নমাসে-ছমাসে বা কয়েক বছরে অন্ধবিশ্বাসের এই রকম এক-আধটা হানাদারি ঠিক সে ভাবেই শত শত বছর পিছিয়ে দেয় আমাদের প্রত্যেককে। কল্পনায়, ভাবনায়, মননে আমরা প্রগতির সৌধ গড়ি। কিন্তু আচমকা হানা দেওয়া সামাজিক অন্ধত্ব লহমায় সে সব চুরমার করে দিয়ে যায়। আবার যেন নতুন করে শুরু করতে হয় সব কিছু।
আমরা হয়তো এর পরেও আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করব। আমরা হয়তো এ বার সংখ্যা গুনব। আগে এমন ঘটনার নিদর্শন ভূরি ভূরি মিলত, এখন বিরল হয়ে এসেছে, তাই ঘটলেই এত অস্বাভাবিক ঠেকে, এত হইচই হয়— এমন হয়তো বলব অনেকে|
সংখ্যায় সত্যিই হয়তো কমেছে এ ধরনের ঘটনা। কিন্তু সংখ্যায় গিয়ে লাভ নেই| এত দিনেও যে নির্মূল করতে পারিনি আমরা এই সামাজিক বিষগুলো, সবচেয়ে লজ্জার সেটাই। দেশের যে কোনও প্রান্তে যখনই ঘটবে এমন কিছু, তখনই গোটা দেশ লজ্জার মুখে পড়বে। যতই এগোক ভারত, এই লজ্জা যত বার হানা দেবে, তত বারই গোটা দেশের সমাজকে নতুন করে প্রগতির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy