Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মন দিয়ে তাঁকে পড়া দরকার

বিবেকানন্দের ইংরেজিতে বলা ক্রমে লেখার আকার পাচ্ছিল, ইংরেজি লেখা বাংলায় অনূদিত হচ্ছিল। সে অবশ্য আরও কিছু দিন পরের কথা। এমনিতে লেখার থেকে বলার প্রতিই যেন বিবেকানন্দের আগ্রহ বেশি

আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৬তম জন্মতিথি

আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৬তম জন্মতিথি

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৭
Share: Save:

বাং‌লা ভাষায় লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই শিকাগো বক্তৃতার সুবাদে বিবেকানন্দ ইংরেজি ভাষায় সুবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। মেরি লুই বার্কের Swami Vivekananda in the West / New Discoveries বইতে বিবেকানন্দের ইংরেজি বলা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া-প্রতিবেদন সংকলিত। সে সব পড়লে দেখা যাবে সাহেবরা বিবেকানন্দের ইংরেজি বলার সামর্থ্যে মুগ্ধ। চমৎকার ইংরেজি বলেন এই ভারতীয় সন্ন্যাসী। এতটাই ভাল যে তাঁদের মনে হয় এ যেন তাঁর নিজের ভাষা। বিবেকানন্দের ইংরেজিতে বলা ক্রমে লেখার আকার পাচ্ছিল, ইংরেজি লেখা বাংলায় অনূদিত হচ্ছিল। সে অবশ্য আরও কিছু দিন পরের কথা। এমনিতে লেখার থেকে বলার প্রতিই যেন বিবেকানন্দের আগ্রহ বেশি। বলা কথা অনেক দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। রামকৃষ্ণানন্দকে ১৮৯৪ সালে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘Lecture ফেক্‌চার তো কিছু লিখে দিই না, একটা লিখে দিয়েছিলুম, যা ছাপিয়েছ। বাকি সব দাঁড়াঝাঁপ, যা মুখে আসে গুরুদেব জুটিয়ে দেন। কাগজপত্রের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই নাই।’ বলেন বটে ‘দাঁড়াঝাঁপ’ তবে কীভাবে বক্তৃতা দিলে শ্রোতারা উজ্জীবিত হবেন সে বিষয়ে তিনি খুবই সচেতন। বাক্‌সর্বস্ব ধর্মপ্রচারকদের পছন্দ করেন না তিনি, বাক্‌ছটায় লোক ভোলানো অনাচার। আবার রামকৃষ্ণানন্দকে এ কথাও লিখতে ভোলেন না, ‘সমাজকে জগৎকে electrify করতে হবে’ ঘণ্টা নাড়লে আর গপ্‌পোবাজি করলে সে হওয়ার জো নাই। ‘তোমাদের কাজ distribution and propagation of thought-currents’। তার জন্যই বক্তৃতা। ইংরেজিতে সে বক্তৃতা চমৎকার দিতেন স্বামীজি। তাঁর কথার তরঙ্গ শ্রোতাদের উদ্দীপিত করত।

আর ভারতীয় ভাষায়? ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতার সংস্কৃতি পাশ্চাত্যে গড়ে উঠেছিল, ভারতীয় ভাষায় তখনও গড়ে ওঠেনি তেমন করে। প্রাগাধুনিক ভারতভূমে কথকতা ছিল, মরমিয়া সাধকদের গীত-কীর্তন-নৃত্য ছিল। কিন্তু বাগ্মিতার নিদর্শন কোথায়? ভারতীয় ভাষায় বক্তৃতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি বলেই তো কংগ্রেসের প্রথম পর্বের নেতারা ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন। বিবেকানন্দ কিন্তু ভারতীয় ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে ভাবপ্রবাহ বিস্তারে আগ্রহী। ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণানন্দকে লিখেছেন, ‘কাল এখানে (আলমোড়ায়) ইংরেজ-মহলে এক লেকচার হয়েছিল, তাতে সকলে বড়ই খুশী। কিন্তু তার আগের দিন হিন্দিতে এক বক্তৃতা করি, তাতে আমি বড়ই খুশী— হিন্দিতে যে oratory করতে পারবো তা তো আগে জানতাম না।’ ভারতীয় ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে নিজের ভাব পৌঁছে দিতে পেরে বিবেকানন্দ অনেক বেশি আনন্দিত, ইংরেজিতে যে বক্তৃতা ভালই করা যায়, আমেরিকা-ইংল্যান্ড ফেরত এই সন্ন্যাসী ভালই জানেন। ভারতীয় ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার গুরুত্ব আলাদা। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে জানিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, ‘ভাষার ভেতর verb-গুলি ব্যবহারের মানে কি জানিস? ঐরূপে ভাবের pause দেওয়া; সেজন্য ভাষায় অধিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করাটা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলার মতো দুর্বলতার চিহ্নমাত্র। ঐরূপ করলে মনে হয়, যেন ভাষার দম নেই। সেইজন্য বাঙলায় ভাল lecture দেওয়া যায় না।’ বাংলা ভাষায় বলা ও লেখার মাধ্যমে কীভাবে গণসংযোগকারী চিন্তাতরঙ্গ সৃষ্টি করা যায় তা বিবেকানন্দের অন্যতম অনুসন্ধানের বিষয়।

এ জন্যই তাঁর লেখায় বাক্‌সংস্কৃতির নানা ছাঁদ চোখে পড়ে। বিবেকানন্দের লেখার ভাষাকে উদ্বোধন সম্পাদক ত্রিগুণাতীতানন্দ ‘উচ্চবিমিশ্র’ ভাষা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর লেখায় কথ্য ভাষা আর তৎসম শব্দ মিলেমিশে থাকে। উদ্দেশ্য শ্রোতা-পাঠকের চিত্তে দোলা দেওয়া। শুধু সাধু বা শুধু চলিতে তা হওয়ার জো নেই। বিবেকানন্দের সুপরিচিত বাংলাভাষার ‘বাণীগুলি’ খেয়াল করলেই দেখা যাবে সেগুলিতে সাধু-চলিত মিলে মিশে আছে। ‘হে ভারতের শ্রমজীবি, তোমার নীরব অনবরতনিন্দিত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বাবিল, ইরান্‌, আলকসন্দ্রিয়া, গ্রীস, রোম, ভিনিস, জেনোয়া… ওলন্দাজ ও ইংরেজের ক্রমান্বয়ে আধিপত্য ও ঐশ্বর্য্য; আর তুমি?– কে ভাবে এ কথা।’ (বিলাতযাত্রীর পত্র) হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল, আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত হইয়া, সদর্পে ডাকিয়া বল, ভারতবাসী আমার ভাই…’ (বর্ত্তমান ভারত) পড়লে মনে হয় নিতান্ত লেখা নয়, বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা গদ্যের কথা ভুলেই গেল বাঙালি?

বিশ শতকে পরাধীন বঙ্গদেশে সমাজ ও রাজনীতির সচেতন চিন্তকরা অনেকেই বিবেকানন্দের এই বাক্‌-দর্শন খেয়াল করেছিলেন। যেমন, গোপাল হালদার, সুভাষচন্দ্র বসু, নজরুল ইসলাম। গোপাল হালদার তাঁর স্মৃতিকথা রূপনারানের কূলে বইতে লিখেছিলেন, ‘বাঙলা লেখার মধ্য দিয়েই প্রথম পেলাম বিবেকানন্দের স্পর্শ— আগুনের পরশমণি।’ নজরুল বিবেকানন্দকে স্মরণ করেছেন উনিশ শতকের বিশের দশকে। ‘সৈনিক’ নজরুলের মনে হয়েছে, ‘কিন্তু সেনাপতি কই?… সে পুরুষ এসেছিল বিবেকানন্দ, সে সেনাপতির পৌরুষ-হুঙ্কার গর্জে উঠেছিল বিবেকানন্দের কণ্ঠে।’ আর সুভাষের বিবেকানন্দ প্রীতি তো সুপরিচিত। দিলীপকুমার রায়ের স্মৃতিকথা পড়লে জানা যায় বক্তা হিসেবে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছিলেন সুভাষ। শুধু ইংরেজি ভাষায় নয়, ভারতীয় ভাষাতেও সুভাষ তাঁর বাক্‌ সঞ্চার করতে চান। সুভাষের এই ভাবনায় বিবেকানন্দের আদর্শ নিহিত আছে।

আজ একুশ শতকে এসে কয়েকটি কথা মনে হয়। উনিশ-বিশ শতকে পরাধীন ভারতে দেশজাগানিয়া বাক্‌সংস্কৃতির গুরুত্ব ছিল খুবই গভীর। তবে কথা ফাঁদও হয়ে উঠতে পারে, তাই সংশয় হয়, বিবেকানন্দকে আমরা বাণীময় করেই রাখলাম না তো! তাঁর বাণীর জনপ্রিয়তা এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে তাঁর রচনা আমরা খুব মন দিয়ে পড়লাম না। তার দায় অবশ্যই বিবেকানন্দের নয়।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE