Advertisement
E-Paper

শাজাহানাবাদ থেকে গুলশন কাফে

কেউ হয়তো তার দাদা দারা শিকোহ্-কে বড় রাস্তায় কচুকাটা করল, দাদা যথেষ্ট মুসলিম নয় বলে। আবার কেউ, বড় রাস্তার উপর তলোয়ার দিয়ে ভ্রূণের মাথায় লিখে দিল ‘ওঁ’, ভ্রূণটা হিন্দু নয় বলে।যার কথা ভাই সবচেয়ে বেশি মানত, সেই আল্লার নামে দোহাই দেয় তার দিদি।‘এই পবিত্র রামাদানের মাসে, এত যুদ্ধ, এত সৈন্যক্ষয়, এত রক্তপাত—আল্লার নামে বন্ধ করো।’

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
নাম ভুলে গেলেও মুখ মনে আছে... গুজরাত দাঙ্গা, ২০০২।

নাম ভুলে গেলেও মুখ মনে আছে... গুজরাত দাঙ্গা, ২০০২।

যার কথা ভাই সবচেয়ে বেশি মানত, সেই আল্লার নামে দোহাই দেয় তার দিদি।

‘এই পবিত্র রামাদানের মাসে, এত যুদ্ধ, এত সৈন্যক্ষয়, এত রক্তপাত—আল্লার নামে বন্ধ করো।’

দিদির কথায় কর্ণপাত করেনি ভাই। বরং যুদ্ধ করেই চলে, করেই চলে। ভাইদের কচুকাটা করে। যে ভাইকে প্রথমে বলে, চল্‌ একসঙ্গে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলি, তাকেই বন্দি করে ফেলে। অন্যের হাত দিয়ে মারিয়েও দেয়। আর এক ভাই পালিয়ে বাঁচে তখনকার মতো, পরে মগের মুল্লুকে প্রাণ হারায়।

তবে সব্বার থেকে শত্রু বড়ভাই। সুফির আড্ডায় যায়, ছবি আঁকে, কবিতা পড়ে। বিয়েও করেছে মাত্তর একটা। এত কিছুর পরেও, কে জানে কোন জাদুর বশে, সবাই ভালবাসে তাকে। আব্বাজান সবচেয়ে ভালবাসেন, বড় আপাজান— যিনি বলতে গেলে সব কিছু চালান— তাঁরও নয়নের মণি এই বড়ভাই। বড়ভাই আবার খুব জেনানাদের ভাল-র কথা ভাবে। পুরনো দাদুর আমলের নিয়ম ছিল, রাজপরিবারের মেয়েরা বিয়ে করতে পারবে না। ভালই তো নিয়ম। অন্য রক্তের মিশেলও আটকানো গেল, আবার যদি তাদের বাচ্চাকাচ্চারা সম্পতির ভাগ চায়— সেই ঝামেলাও রইল না।

সে সব নিয়মও উঠিয়ে দেবে এই কবি ভাই। দিদি তার জন্য চিন্তা করে, অ-কবি ভাইকে চিঠি লেখে, আগরা থেকে ঔরঙ্গাবাদ অবধি বয়ে আসে। বলে, ভাগাভাগি করে নাও বরং, যুদ্ধ কোরো না।

দিদিকে মুখের উপর ‘না’ বলে না। দিদিও নাকি কবিতা লেখে, সুফিদের বাড়ি যায় আসে। এমনকী হারেমে ঢোকে ফিরিঙ্গি ডাক্তার। সে অবশ্য খুব পুড়ে গিয়েছিল দিদি, তাই। কিন্তু তাতে কী? মরে যেত তো যেত। তবু ফিরিঙ্গি ডাক্তার গায়ে হাত দিয়ে দেখার থেকে তো ভাল হত।

‘দিদি তোর হিজাব কোথায়?’

যদিও বোরখা পরে বেগমের মতোই এসেছিল দিদি, তবুও এটাই জানতে ইচ্ছে করেছিল ভাইয়ের। মুখে বলেনি, কিন্তু যাদের আহ্লাদে এ-সব কুশিক্ষা, তাদের নিয়েছিল এক হাত।

বড়ভাইটাকে যুদ্ধে হারিয়ে, তার পর শেকলে বেঁধে হাতির পিঠে ঘুরিয়েছিল বড় রাস্তায়। বাবার প্রাসাদের, দিদির ম্যানসনের দু’হাত দূরে। তার পর ডেকে পাঠিয়েছিল বড়ভাইয়ের ছেলেকে। খুব বেশি বয়স নয় তার, তবু ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাটা ঠিক হওয়া দরকার।

শেকলে বাঁধা তার বাবা, চার জন কুপিয়ে মেরে ফেলে তাকে। ছেলেটা চোখে বন্ধ করেও ফেলতে চায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে তো হবে না। ধর্ম হল ধর্ম। কষ্ট করে শিখতে হয়। তার পর সেই কাটা মুন্ডু নিয়ে যেতে হবে আব্বাজানের কাছে। বড় আপাজানের কাছে। তবে সবার সামনে সেটা করা যাবে না। এখন তো আর আমি যে-সে নয়, সম্রাট হতে চলেছি! তবে ইসলাম না মানলে তার ফল এই— এটুকু তো শিক্ষে হল। আর ঠিকমত ধর্ম মেনে সম্রাটটি হলে, কেউ কি মনে রাখবে বড় রাস্তায় ছোট ছেলের সামনে তার শেকলে বাঁধা বাবাকে কেমন কচুকাটা করেছিল কাকা? কেউ মনে রাখবে না।

সে অবশ্য ঠিকমত ধর্ম মেনে চললে ইসলাম কেন, সব ধর্মই এক। হয়তো কেউ কখনও রেশন কার্ড দেখে খুঁজে খুঁজে বের করল— কে হিন্দু নয়। তার পর সেই-সেই লোকের বাড়িতে আগুন লাগাল। বড় রাস্তার উপর তলোয়ার দিয়ে ভ্রূণের মাথায় লিখে দিল ‘ওঁ’। ওঁ খুব ভাল শব্দ, উচ্চারণে সব পাপক্ষালন হয়। এই বড় রাস্তার আইডিয়াটা হয়তো ওই মুসলমান সম্রাটের থেকেই ধার নেওয়া— সেটাও তো ছোটখাটো পাপ বটে— কিন্তু সে সব ধুয়ে মুছে যায়। ইতিহাস শুধু মনে রাখে, মেরে কেটে প্রধানমন্ত্রী, থুড়ি, রাজা হওয়া গেল কি না। রাজার নাম, থুড়ি, দেশের নামে জয় বলতে হবে, না হলে গলা কেটে নেবে, বলেছে সেই রাজার সঙ্গে থাকা সাধু।

এই যেমন তোমায় কলমা পড়তে বলেছিল ওরা। তুমি রেডি ছিলে না মানছি। তুমি খাবার খেতে গিয়েছিলে এক জায়গায়, হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে তোমার কলমা না-ই মনে পড়তে পারে। কিন্তু না মনে পড়লে, রমজানের মাস বলে, ওরা তোমায় ভালবেসে ছেড়ে দিতে পারে— এ কথা তোমার মনেই বা হল কেন? এক্ষুনি বললাম না, আর একটা রমজান মাসের গল্প? তুমি ভেবেছিলে তোমার দেশ, তোমার বাবা-কাকারা এই দেশের জন্য, এই দেশের ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিল, সেখানে এমনটা হতেই পারে না। হ্যাঁ, আগে এই দেশে কয়েক জনকে এই সব জঙ্গি চাপাতি দিয়ে মেরেছে, গুলি করে মেরেছে। কিন্তু তারা তো তবু ওদের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিল। আমি শুধু কফি খেতে এসেছি। আমার নিজের দেশে, আমার চেনা জায়গায়।

আবার দেখো কী কাণ্ড, আমার দুই বন্ধুকেও ডেকেছি। এক জন আবার এসেছে সেই ওঁ-দেশ থেকে। তবে তাতে কিছু এসে যায়নি, আরও অন্য অন্য দেশের লোকেরাও ছিল। তারা কলমা পড়বে কী করে? আর তারা কেন, আমিও পড়তে পারিনি। আমার মনে ছিল বোধহয়, কিন্তু আমার দেশে কার না কার কথায় আমায় কলমা পড়তে হবে কেন? আমি দেশকে এমনিই ভালবাসি, আটা ঘি নুডলস্‌ কেনাবেচা না করলেও ভালবাসি, আমাকে ‘দেশমাতা কি জয়’ বলতে হবেই বা কেন?

একই কথা বলছিল ইরশাদ আপাজানও। ও এই দেশের মেয়ে, এখানেই বড় হয়েছে, কিন্তু কখনও হিজাব পরেনি।

ওকেও প্রশ্ন করেছিল এ কালের ইসলামের রক্ষক:

‘আপাজান, তোমার হিজাব কোথায়?’

যেমন আরব সাগরের তীরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল তার পছন্দের পোশাক পরা এক তরুণী— তার গাড়ি থামিয়ে— বড় রাস্তায়...

ভাল টেকনিকই শিখিয়েছিলেন সম্রাট আলমগীর। যে টেকনিকে দারা শিকোহ্ কচুকাটা, জাহানারা শাহ্জাহান বন্দি— সেই টেকনিক আজও কেমন হিট। যত পিছোচ্ছি, তত এগোচ্ছি। যত এগোচ্ছি, তত পিছোচ্ছি। শুধু পড়ে থাকছে কিছু কচুকাটা লাশ, আগরা দুর্গের সামনে, শাজাহানাবাদের রাস্তায়, গোধরা স্টেশনে, বাগদাদের বাজারে...

শুধু একটাই আশা, মানুষ এখনও দারা শিকোহ্‌কে ভোলেনি। তার পর, সেই যে একটা মুখ, যে সবরমতীর ধারের রাজ্যে হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছিল— কে জানে কার— তার নাম ভুলে গেছে, কিন্তু মুখ ভোলেনি। তেমনই হয়তো নাম ভুলে যাবে ফারাজ আয়াজ হুসেনের— যাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল জঙ্গিরা। কিন্তু সে হাত ছাড়েনি তার বন্ধুর— যে তার পাশের দেশ থেকে এসেছিল— যার ধর্মে কলমা পড়া মানা।

দারা শিকোহ্, জাহানারা আপা, ইরশাদ আপা, তারিশি, অবিন্তা, ফারাজ হুসেন, সবাই মিলে বড় রাস্তায় একটা বড় কিছু করি। মোমবাতি নয়, মোমবাতি নয়, ও তো গলে গিয়ে শেষ হয়ে যায়। এমন কিছু, যাতে প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন ধরেছে দেখেও দরজা বন্ধ না হয়।

যাতে কলমা বা ওঁ বা জয় অমুক মুখস্থ ধরে তার পর মানুষ-অমানুষ বিচারের সাহস না পায় কেউ, যাতে মন্দিরে ঢোকার সময় কোনও মহিলাকে কেউ জিজ্ঞাসা না করার সাহস না পায়...

লিস্টি লম্বা, লোক কম। ভয় পেলেন না তো?

Terror attack Nightmare Miscreants victims Ramdan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy