Advertisement
E-Paper

রাজনীতিতে থাকতে হলে ব্যক্তিজীবনে কিছু নিয়ম মানতে হয়

যে শোভনকে এত দিন দেখে এসেছি, তিনি এক কথায় খুবই বর্ণময়, সামাজিক এবং পারিবারিক। রসে-বশে টইটম্বুর জীবন কাটাতে ভালবাসেন। শখ-শৌখিনতায় অকৃপণ।

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০

শ্রীমান শোভন চট্টোপাধ্যায়কে আমি দীর্ঘ দিন চিনি। ১৯৮৫-তে শোভন যখন প্রথম কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর হন, তখন থেকে তাঁকে দেখছি। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে আমাদের সম্পর্ক ক্রমশ ভাই-বন্ধুর মতো হয়েছে। তিনি মন্ত্রী না মেয়র, নেতা না বিধায়ক সে সব এ ক্ষেত্রে ধর্তব্যই নয়।

যে শোভনকে এত দিন দেখে এসেছি, তিনি এক কথায় খুবই বর্ণময়, সামাজিক এবং পারিবারিক। রসে-বশে টইটম্বুর জীবন কাটাতে ভালবাসেন। শখ-শৌখিনতায় অকৃপণ। নিজের বিলাসিতাকে গোপন করার অহেতুক চাতুরিও করেন না। বরং বহুমূল্য ঘড়ি, গাড়ি, পোশাক-আশাক বুক চিতিয়ে ভোগ করেন। পাশাপাশি তিনি আন্তরিক, পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল। কোনও লোকের আপদ-বিপদে, প্রয়োজনে দু-হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াতেও তাঁকে অনেক বার দেখেছি।

রাজনীতিতে তিনি আক্ষরিক অর্থেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্রিত। কংগ্রেসে থাকার সময় থেকে মমতার প্রিয়পাত্র। সময়ের সঙ্গে দলনেত্রীর কাছে শোভনের (যাঁকে তিনি ডাকনাম ধরে কানন বলেন) গুরুত্ব বেড়েছে। তৃণমূল রাজ্যপাট দখলের আগেই দ্বিতীয় দফায় কলকাতা পুরসভা জেতে। শোভনকে মেয়র করেন মমতা। সেই থেকে একটানা মেয়র শোভন। এখন আবার মন্ত্রীও। সঙ্গে দুই জেলার তৃণমূল সভাপতি। তবে, এই সব দলীয় অবস্থান বা পদাধিকারের বাইরেও তিনি নিজগুণে মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে এক অতি বিশ্বস্ত সেনানী।

অন্তত এত দিন সেটাই জানা ছিল। কিন্তু সেই শোভন হঠাৎ এলোমেলো। যেন কালবৈশাখীর ঝড়ে বেসামাল। যা শুরু করে দিয়েছেন, তাতে মমতা বা তৃণমূলের বিড়ম্বনায় পড়া তো কম কথা, সাধারণ ভাবে ‘পাবলিক লাইফ’-এ থাকা এক জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির আচার-আচরণের শোভনতাই গুরুতর প্রশ্নের মুখে। এমন ঘটনার সামাজিক অভিঘাত এড়ানো যায় না। তাই ব্যক্তি শোভনের কার্যকলাপ আজ আলোচনার বিষয়।

বলে রাখা ভাল, কারও ব্যক্তিগত জীবনের অন্দরে উঁকি মারা অশোভন। কে কী ভাবে নিজের জীবনের ভাল-মন্দ স্থির করবেন, সেটা প্রধানত তাঁর নিজের বিবেচনা। কিন্তু এক জন জননেতা যদি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপনকে আলোচনার খোরাক করে তোলেন, নিজেই তাতে নিয়ত ইন্ধন জুগিয়ে যান, সরকারি বা প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব পালনে শিথিলতা দেখাতে থাকেন, তখন আর বিষয়টি ‘নিছক ব্যক্তিগত’ বলে ধামাচাপা দেওয়া যায় না।

ঘটনা হল, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছে। তিনি নিজেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিবিধ সংবেদনশীল বিষয়কে হাঁড়িতে ভরে হাটে এনে ভেঙেছেন। ফলে পালটা হিসাবে আরও কিছু কেচ্ছাজনক প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন তাঁর স্ত্রী এবং অন্য পরিজনেরা।

পুরভবনে মেয়রের চেয়ারে বসে শ্রীমান শোভন প্রকাশ্যে তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখের অনেক কথা বলেছেন। হয়তো আরও বলবেন। সে সব কথার সত্যতা বিচারের ক্ষেত্র ভিন্ন। সে দায়ও আমাদের নয়। তবে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর বক্তব্য থেকে যে কোনও সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বুঝতে পেরেছেন, মেয়র স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন এবং অন্য এক অনুরাগিণী ‘বন্ধু’কে একমাত্র নির্ভরশীল আশ্রয় ও বাঁচার প্রেরণা বলে আঁকড়ে ধরেছেন।

প্রতি দিন প্রচারমাধ্যমে শোভনের অসহায়তা, জীবনহানির আশঙ্কা, নিজের ‘বাঁচার’ তাগিদে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিবার সবাইকে ছেড়ে বেরিয়ে আসার বর্ণনা শুনতে শুনতে তাঁর প্রতি কিছু লোকের করুণা জাগ্রত হওয়াও অসম্ভব নয়। তাঁকে চিনি। তাই খারাপ তো আমারও লাগছে।

কিন্তু, এক জন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি তথা প্রশাসক তাঁর সংসার ও জীবনের এ রকম একটি ভেঙে পড়া চেহারা এবং হতাশার বারোমাস্যা সামনে নিয়ে এলে সমাজ কী বার্তা পায়?

কারও বিবাহিত জীবনে সমস্যা আসতে পারে, দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ হতে পারে, দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির সদর্প আবির্ভাবও ঘটতে পারে। কিন্তু এক জন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকের জীবনযাপনের নিজস্ব কিছু রীতি-নিয়ম আছে। যেটা তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার অঙ্গ। তেমন মর্যাদাসম্পন্ন এক জন যদি প্রচার মাধ্যমের কাছে বার বার নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসা করেন, অন্য এক বিবাহিতা মহিলাকে বেঁচে থাকার অন্যতম প্রেরণা রূপে চিহ্নিত করেন, সেই মহিলার উপর কোনও রকম ‘আঘাত’ এলে তা নিজের উপর আঘাত বলে ঘোষণা করেন, তা হলে জনমানসে সেই নেতার ভাবমূর্তি কিছুতেই উজ্জ্বল থাকতে পারে না। তিনি যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার গায়েও কালি লাগতে বাধ্য। কোনও যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যায় এই কঠিন বাস্তবকে আড়াল করা যাবে না। মমতা ও তাঁর দলকে শোভন সেই বিপাকে ফেলে দিয়েছেন।

আমরা যে সমাজে বাস করি, তার আষ্টেপৃষ্ঠে এখনও কিছু ধ্যানধারণা জড়িয়ে রয়েছে। তাকে ‘মূল্যবোধ’ বলা যাবে কি না, জানি না। তবে প্রকাশ্যে চট করে এগুলি নস্যাৎ করা কঠিন।

যাঁরা রাজনীতি করেন, ভোটে জিতে নেতা হতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে জনসমক্ষে এগুলি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা বেশি। কারণ, যাঁদের নিয়ে তাঁদের রাজনীতি, সেই বিপুল সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিতে ভাল-মন্দের নিজস্ব মাপকাঠি আছে। সেখানে দু-দশ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ বা সিবিআইয়ের জেরায় জড়ানোর চেয়ে ঢের বেশি সহজবোধ্য হল দাম্পত্য সঙ্কট, পারিবারিক অশান্তি, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের মতো বিষয়। যার সঙ্গে, তাঁদের বিচারে,‘চরিত্র’-র সংজ্ঞা জড়িত। হিসাব না মিললেই মুশকিল। তাঁরা মানতে পারেন না।

তাই হয়তো অতি আধুনিকা কেতাদুরস্ত অভিনেত্রীকেও সিঁদুর পরে ঘোমটা টেনে ভোট চাইতে বেরোতে হয়। নেতাকে কথায় কথায় বোঝাতে হয়, তাঁর স্ত্রী সর্বদা পাশে আছেন। রাজনীতির বাজারে দেখনদারিটাও যে বড্ড জরুরি! যিনি যত বড় মাপের, তাঁর পক্ষে ঝুঁকি তত বেশি। মেপে পা ফেলার জন্য সতর্কতাও আবশ্যিক। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই নিজের সিদ্ধান্তে অটল শোভন সেই লক্ষ্মণরেখার বাইরে চলে এসেছেন।

তাঁর দল এ সব নিয়ে কী ভাবছে বা কী করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। তাঁর স্নেহাস্পদ কাননকে মমতা ‘সংযত’ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারবেন কি না, তা-ও ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, জনসাধারণের মনের ধারণা তার উপর নির্ভর করে না। আর ভোট-নির্ভর রাজনীতিতে আমজনতার মনোভাবকে মূল্য দিতেই হয়।

শোভন-অশোভনের দ্বন্দ্বে শ্রীমান শোভনের এঁটে ওঠা তাই এ বার বোধহয় কিছুটা কঠিন।

Sovan Chatterjee TMC Mayor Accused Personal Activity
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy