n জনসংযোগ: নিহত গ্রামবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, ১০ ডিসেম্বর। পিটিআই
ডায়মন্ড হারবারে দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে যাওয়ার সময় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কালো দিন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রকম চরম অগণতান্ত্রিক একটি ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। বিরোধীদের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণুতাই এমন ঘটনা ঘটানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এক হাতে তাঁর সরকার দশকীয় কর্মদক্ষতার রিপোর্ট প্রকাশ করছে, অন্য হাতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা একটি জাতীয় দলের সর্বভারতীয় সভাপতির কনভয়ে ইট-পাথর ছুড়ছে দলের পতাকা হাতে নিয়ে, স্লোগান দিতে দিতে।
এটা ভুললে চলবে না যে, নড্ডা এক জন সাংসদ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁর কনভয়ে হামলা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের গা-ছাড়া মনোভাব, পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক মন্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, হয় রাজ্য সরকার বিষয়টিকে লঘু করে দেখছে অথবা শাসক দল তার ক্যাডারদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এই আক্রমণ বিষয়টিকে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ ‘মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’ বলে দাবি করেছেন, যা হাস্যকর এবং কোনও মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। নানা সময়ে বামপন্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবাদ হিংসাত্মক রূপ নিলে ওঁরাও দাবি করেন শাসক-শক্তির বিরুদ্ধে এটা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ।
তা হলে কি আমরা ধরে নেব পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের আত্মা, রাজ্যের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং ভবিষ্যৎ আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে? যত দিন যাচ্ছে এটা পরিষ্কার যে, তৃণমূল শাসনে পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের রেখচিত্র দ্রুত নিম্নমুখী। করোনা এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ে শান্তিপূর্ণ বিহার বিধানসভা নির্বাচন প্রমাণ করে, এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী রাজ্য বিহার।
পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৯-এর শেষ লোকসভা নির্বাচন সাক্ষী থেকেছে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার পাশাপাশি বিজেপি কর্মীদের উপর অত্যাচার বাড়ার। তৃণমূলের শাসন পশ্চিমবঙ্গকে ঠিক সে জায়গাতে নিয়ে গেছে, এক দিন যেখানে লালুর শাসনে বিহার ছিল। তৃণমূল শাসনে পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক হত্যা, তুষ্টি এবং বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়েছে বার বার।
এই কাদা থেকে পশ্চিমবঙ্গকে উঠে আসতে হবে দেশের প্রথম সারির রাজ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার জন্য জরুরি, তৃণমূল শাসনের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবকে মানুষের সামনে নিয়ে আসা। এই মনোভাব প্রতি পদে দেশ ও রাজ্যের মধ্যে থাকা সাংবিধানিক যোগসূত্রগুলিকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলছে। এই মানসিকতাই চরম অগণতান্ত্রিক ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব তৈরি করেছে। তৃণমূলের এই মনোভাব পশ্চিমবঙ্গকে সকলের থেকে দূরে সরিয়ে রাজ্যের মানুষদের বঞ্চিত করে রাখছে। তৃণমূলের এই মানসিকতাকে প্রত্যাখ্যান ও পরাজিত করা প্রয়োজন, যাতে পশ্চিমবঙ্গ আবার আগের মতো তার বহুমাত্রিক ক্ষমতায় সজ্জিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘নতুন ভারত’-এর স্বপ্ন পূরণে নেতৃত্ব দিতে পারে।
তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে জোর করে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব প্রচার করতে চাইছে, যেটা আসলে ওদের নিজেদের অগণতান্ত্রিক মনোভাবকে প্রকাশ করে। ভারতীয় সংবিধানের সেই অস্তিত্বকে অস্বীকার করে— যার বলে দেশের যে কোনও নাগরিক দেশের যে কোনও জায়গাতে স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা, বসবাস কিংবা ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করতে পারেন। এই ধরনের চরম প্রাদেশিক মনোভাব কখনও বাংলার ছিল না। এটা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বহিরাগত বলছেন। এর আগে কখনও পশ্চিমবঙ্গ এমন দেখেনি। বিজেপির মতো একটি জাতীয় দলকে বহিরাগত বলা হাস্যাস্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা এবং আধুনিক বাংলার এক প্রথম সারির জননায়ক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাতে তৈরি ভারতীয় জনসঙ্ঘের উত্তরাধিকারী আজকের বিজেপি। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রথম বার বাংলায় বক্তব্য রেখেছিলেন গুরুদেব। যদি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শের উত্তরাধিকারীরা পশ্চিমবঙ্গে বহিরাগত হন, তা হলে কারা পশ্চিমবঙ্গের ভিতরের লোক, সেটাই বড় প্রশ্ন। শেষ বারের জন্য যখন তিনি কাশ্মীরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন, তিনি কি ভেবেছিলেন যে কাশ্মীরে বাঙালি বহিরাগত হিসেবে কেন লড়াই করবেন? না, বরং দেশের একতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি।
আমরা কি ভুলতে পারি যে, দেশের অন্যতম সেরা গণিতমস্তিষ্ক আচার্য দেবপ্রসাদ ঘোষ ভারতীয় জনসঙ্ঘের দ্বিতীয় সভাপতি এবং প্রথম রাজ্যসভা সদস্য ছিলেন। এঁর রাজনৈতিক মতাদর্শে চলা দলটি পশ্চিমবঙ্গে ‘বহিরাগত’? মজার বিষয় হল পশ্চিমবঙ্গে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকেদের আরাধ্য হলেন মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন। এঁদের বিষয়ে পড়ানো হলেও রাজ্যের স্কুলপাঠ্য বইয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের জায়গা হয় না। দেশের আরও অনেক বিপ্লবী ও আদর্শ ব্যক্তিদের পাঠ্যবইয়ে একঘরে করে রাখা হয়। বাংলার জন্য স্বপ্ন দেখা মহান ব্যক্তিত্বদের অবজ্ঞা করে চলা হয়। তৃণমূলও এ বিষয়ে কোনও পরিবর্তন করেনি। উল্টে দেখা গিয়েছে অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে বিচার করা হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বসঙ্কট তৈরি করা এই ‘বহিরাগত’ নাটক অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। খুবই সঙ্কীর্ণ মানসিকতার রাজনৈতিক প্রচার কৌশল এই নাটক, যা তৃণমূল সরকার পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গের আত্মার বিরোধী তার বর্তমান শাসকের এই নির্বুদ্ধিতাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক আবহাওয়া পরিবর্তনের ঘোষক। রাজ্যের নতুন আশা ও সম্ভাবনা তৈরির মঞ্চ।
ডিরেক্টর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রিসার্চ
ফাউন্ডেশন, দিল্লি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy