Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Ram Mandir

স্বাধীনতা!

কোনও হিংসা ব্যতীতই রামমন্দির প্রতিষ্ঠিত হইতেছে বলিয়া সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী।

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২০ ০০:৪৮
Share: Save:

রামমন্দিরের ভূমিপূজার দিনটি আরও এক স্বাধীনতা দিবস, প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন। কথাটি মিথ্যা নহে। ‘ভারত’ নামক ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, প্রগতিশীল এক ধারণার অধীনতা হইতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ এই দিন স্বাধীন হইল বটে। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্টের মধ্যরাত্রে নিয়তির সহিত অভিসারের মুহূর্তে ভারত যে শপথ লইয়াছিল, হিন্দুত্ববাদী ভারত শেষ অবধি তাহা হইতে স্বাধীন হইল ঠিকই। কিন্তু, ভারতের যে ধারণাটিকে ধ্বস্ত, অপমানিত অবস্থায় পথপার্শ্বে ত্যাগ করিয়া হিন্দুত্ববাদীরা তাঁহাদের ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করিলেন, সেই পরাভূত ধারণাটির মর্যাদা রক্ষা করিতেই কি নরেন্দ্র মোদী সংবিধানের নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নহেন? দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনও একটি বিশেষ ধর্মের মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিতেছেন, ইহা কি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী নহে? সংবিধান হইতে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ অপসারণের প্রচেষ্টা আরম্ভ হইয়াছে বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্মরণে রাখিতে পারিতেন, তিনি এখনও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরই নেতা, হিন্দু রাষ্ট্রের নহেন। সংবিধানের আব্রু রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসাবে নাগরিক সমাজ তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াছিল এই অনুষ্ঠানের সহিত যুক্ত না হইতে। স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল, সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হইতে কী ভাবে নিজেকে দূরে রাখিয়াছিলেন জওহরলাল নেহরু। সেই আবেদনে তিনি কর্ণপাত করেন নাই। হয়তো উদার ভারতের ধারণাটি হইতে স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তটিতে নিজের নাম লিখিবার আকর্ষণ তাঁহার নিকট অপ্রতিরোধ্য। হয়তো ভারতবর্ষ নামটি হইতে এত কালের নিহিত ব্যঞ্জনা অপসারণের সহিত তিনি ব্যক্তিগত সংযোগ চাহিয়াছিলেন।

কোনও হিংসা ব্যতীতই রামমন্দির প্রতিষ্ঠিত হইতেছে বলিয়া সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী। সত্য, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অযোধ্যার রাজপথে রক্তগঙ্গা বহে নাই, মন্দির প্রতিষ্ঠার উচ্ছ্বাসে দেশ জুড়িয়া হত্যালীলা সংঘটিত হয় নাই। কিন্তু, এই মন্দিরের ভিতে হিংসা নাই, এই কথাটি বলিতে গেলে আশ্চর্য রকম ইতিহাসবিস্মৃত হইতে হয়। ভুলিতে হয়, যে জমিতে মন্দিরের ভিতপূজা হইল, সেখানে একটি পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ ছিল। তাহার ইতিহাস ছিল, তাহাকে ঘিরিয়া সমাজ ছিল— সেই সমাজ শুধু মুসলমানদের নহে, তাহাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নির্ভুল সুবাস ছিল। তাহাকে ধ্বংস করিয়া ফেলা হিংসা নহে? অযোধ্যায় মুসলমানরা ক্রমে বে-জবান হইয়াছেন, ধনে-প্রাণে বাঁচিবার শেষ চেষ্টা হিসাবে তাঁহারা এক অর্থে নাগরিকত্বের দাবিটুকুও বিসর্জন দিয়াছেন, তাহা হিংসা নহে? মসজিদ ধূলিসাৎ হইবার পরও কোথাও একটি বিশ্বাস বাঁচিয়া ছিল যে, সেই ধ্বংসের কারবারিদের শেষ হাসি হাসিতে দিবে না ভারতীয় রাষ্ট্র— ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সেই আস্থার মৃত্যু হিংসা নহে? মন্দিরের ভিত স্থাপিত হইয়াছে, কিন্তু সেই আনন্দে কি এই ইতিহাস অস্বীকার করা চলে? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবক তাহা করিতে পারেন?

প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘স্বাধীন’ ভারতে প্রশ্নগুলি সম্ভবত অবান্তর। উদার ভারতের ধারণাটিকে প্রতিহত করিবার উদ্দেশ্যেই যেন প্রধানমন্ত্রী বলিলেন, রাম সবার— রামই ভারতকে একাত্মতার সূত্রে বাঁধিতে পারেন। তিনিও সম্যক জানেন, কথাটি অসত্য। শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাই নহেন, শুধু আদিবাসী-দলিতরাই নহেন, জন্মসূত্রে বর্ণহিন্দু অনেক নাগরিকও এই রামের একতার সূত্রে বাঁধা পড়িবেন না। দুর্ভাগ্য। দুর্ভাগ্য কেবল তাঁহার বিরোধী ভারতের নহে, তাঁহার সমর্থক ভারতেরও। রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন দেখিবেন বলিয়া, অতিমারির প্রলয়ঙ্কর তাণ্ডবের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়াইয়াও যাঁহারা ভক্তির আতিশয্যে অযোধ্যায় জড়ো হইয়াছিলেন, নেতাদের স্পর্ধিত অন্ধতায় তাঁহারাও বুঝিবার সুযোগ পাইলেন না যে রামলালার প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের জন্য ভারতের ধারণাটির উপর এত বড় আক্রমণ করিতে নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ram Mandir Ayodhya Bhumi Pujan Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE