বিন্দুমাত্র খেয়াল না করেই প্রাত্যহিকতার হরেক ভাঁজে পরিযায়ী শ্রমিকদের উৎপাদন ব্যবহার করে বেঁচে থাকা শহুরে মধ্যবিত্ত মার্চের শেষ সপ্তাহে হঠাৎই এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব টের পেয়েছিল। আচমকা লকডাউন সেই শ্রমিকদের জীর্ণ ঘরের আগলটুকু ভেঙে দিয়েছিল— তাঁরা দল বেঁধে রাস্তায় নেমেছিলেন ঘর থেকে ঘরে ফেরার তাগিদে। আশ্চর্য! লকডাউন তো ঘোষিত হয়েছিল মানুষকে ঘরবন্দি করার জন্য— কতখানি বিপরীত ফলদায়ী হল সেই নীতি! শহরের গৃহস্থ বাড়ি, রেস্তরাঁ, অফিস, কারখানা, নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাট— লকডাউন প্রতিটি পরিসর থেকে উপড়ে নিল অজস্র পুরুষ, নারী, শিশুকে— তাঁদের উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেলল রাস্তায়। গৃহকোণে বন্দি হওয়ার জন্য তো আগে সেই গৃহে পৌঁছনো দরকার— গ্রামে ফেরার জন্য তাঁরা হন্যে হলেন যে কোনও একটা পরিবহণের খোঁজে। যাঁদের কোনও পরিবহণ জুটল না, তাঁরা হাঁটলেন, মাইলের পর মাইল, অনাহারে, ক্লান্ত শরীরে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিসরে মিডিয়া ঢেউয়ের মতো আছড়ে ফেলতে লাগল সেই ছবি। ৮ মে তারিখে আমরা ছবি দেখলাম, বিষণ্ণ রেললাইনে পড়ে আছে কয়েকটা শুকনো রুটি— যাঁদের পুঁটলি থেকে পড়েছে, রেললাইনের ওপর ঘুমিয়ে পড়া হা-ক্লান্ত সেই মানুষগুলোকে খানিক আগে পিষে দিয়ে গিয়েছে এক নৈর্ব্যক্তিক ট্রেন।
একে কি আমরা বিপরীত পরিযাণ বলব? সঙ্কট যখন প্রতি দিন তীব্রতর হচ্ছে, তখন কিছু তাত্ত্বিক লিখলেন, নির্মম শহর উচ্ছেদ করল এই পরিযায়ী শ্রমিকদের— এবং, তার ফলে সামাজিক বিশ্বাসের গায়ে এক সুগভীর আঁচড় লাগল। যে পরিযায়ীরা এ ভাবে শহর ছাড়তে বাধ্য হলেন, তাঁরা আর কখনও ফিরবেন না শহরে। সেই ভবিষ্যদ্বাণীর রেশ মেলানোর আগেই, যে মুহূর্তে শহরে ফেরার যানবাহন মিলতে আরম্ভ করল, পরিযায়ী শ্রমিকরা ফের শহরমুখী। যে পরিযায়ীরা গ্রামে ফিরতে পারেননি, তাঁরা শহরে থেকে যাওয়াই মনস্থ করলেন। অনেকেই শহরে ফেরার ইচ্ছের কথা জানিয়েও পরিবহণের অভাবে ফিরতে পারলেন না। অগস্টের ১২ তারিখ সিএসডিএস-এর একটি সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের গোড়ায় যাঁরা গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, অতিমারির প্রকোপ কমলে তাঁরা ফের শহরে যেতে চান।
যাঁরা ‘ঘর’-এ ফিরেছিলেন, ঘর তাঁদের অনেককেই তেমন ভাবে স্বাগত জানায়নি। অতিমারির ভয়ে সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা তাঁদের ওপর হরেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, সেটা গৌণ সমস্যা। যে কারণে তাঁরা পরিযায়ী হয়েছিলেন, সেই কারণটা উবে যায়নি, এটাই আসল সমস্যা। বস্তুত, অতিমারির ধাক্কায় তাঁরা ঘরে ফেরায় বাড়ির আর্থিক সমস্যা তীব্রতর হয়েছে। যাঁরা ঘরে ফিরলেন, সরকার তাঁদের জন্য রেশনে চাল-গম দিল, কিন্তু শুধু সেটুকুতে কি দিন চলে? পরিযায়ীদের হাতে কিছু নগদ টাকা তুলে দেওয়া হোক, আচমকা ঘরে ফেরার ধাক্কা সামলানোর জন্য আর অন্য যা ব্যবস্থা করার, করা হোক— বারংবার এই আবেদন শোনা গিয়েছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেননি। শহর থেকে পাঠানো যৎসামান্য টাকার ওপরও যে পরিবারগুলোর ভরণপোষণ নির্ভর করত, তারা আতান্তরে পড়ল। সিএসডিএস-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অন্তত ৪০ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারকে খাবারের পরিমাণে কাটছাঁট করতে হয়েছে। কৃষি-আয়েও ধাক্কা লেগেছে। সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত কৃষকদের আশি শতাংশই জানিয়েছেন, উৎপন্ন ফসল বেচতে মুশকিলে পড়েছেন তাঁরা। এই অবস্থায়, শহর থেকে ফেরা পরিযায়ীদের জায়গা করে দেওয়া গ্রামীণ পরিবারগুলির পক্ষে নিতান্ত সহজ হয়নি।