Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Ram Mandir

ছেড়েছিলেন রাজগৃহ, রাজত্বও

সবার সঙ্গে আমিও গলা মেলাতাম। ভাল লাগার একটা কারণ ছিল সন্ধ্যাবেলার লেখাপড়ার সময় কিছুটা কমত। অন্য কারণটি আমার ব্যক্তিগত।

তাজুদ্দিন আহ্মেদ
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২০ ০০:৩৬
Share: Save:

‘সে মন্দিরে দেব নাই’ কহে সাধু।

(দীন দান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আমার শৈশব এবং কিশোরবেলা পুরুলিয়া জেলার রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত যে আবাসিক বিদ্যালয়ে কেটেছে, সেখানে মাসে এক দিন করে সন্ধ্যাবেলার প্রার্থনার পর রামনাম অনুষ্ঠিত হত। কিছু গান এবং কিছু স্তোত্র— এই ছিল আমাদের রামনাম। সবার সঙ্গে আমিও গলা মেলাতাম। ভাল লাগার একটা কারণ ছিল সন্ধ্যাবেলার লেখাপড়ার সময় কিছুটা কমত। অন্য কারণটি আমার ব্যক্তিগত। ওই গান আর স্তোত্রের ছন্দ আমাকে আমার পারিপার্শ্বিক থেকে অনেক দূরে কোনও এক গল্পকথার দেশে নিয়ে যেত, যেখানে দুই রাজকুমার জঙ্গলের মধ্যে পর্ণকুটির বানিয়ে বাস করছেন। লড়াই করছেন রাক্ষসদের সঙ্গে। তার পর নবম বা দশম শ্রেণির পাঠ্য তালিকায় এল কৃত্তিবাসী রামায়ণের অংশবিশেষ— রামের বিলাপ। সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হল এক কুসুমকোমল রামচন্দ্রের, যিনি সীতা হরণের পর শোকে মগ্ন। নিজেকে মণিহারা ফণীর সঙ্গে তুলনা করে প্রকৃতির প্রতিটি অণুকণার মধ্যেই সীতার ছায়া খুঁজে পাচ্ছেন এই তরুণ। আদ্যন্ত পরিবারনিষ্ঠ এই রাম পত্নীবিচ্ছেদে কাতর; তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্নেহশীল ভাই। রামের এই ছবি চিরকালের জন্য আমার মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। আর হ্যাঁ, আমার এই রাম তো আদর্শ সন্তানও, যিনি পিতার কথার মর্যাদা রক্ষার জন্য গৃহ থেকে নির্বাসন নিয়ে বনবাসে ছিলেন বারো বছর।

আর এই ২০২০ সালের ৫ অগস্ট তিনি নাকি উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যাতে ফিরে পেলেন নিজ গৃহ, নিজ জন্মস্থান। অন্তত সেই রকমটাই শুনছি। বড় আনন্দের এই ক্ষণ; সারা দেশ আজ আনন্দে উচ্ছ্বসিত। অন্তত সেই রকমটাই আমাদের বলা হয়েছে। কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে, যে রামচন্দ্রকে সেই কৈশোরে আমি মনমাঝারে স্থাপন করেছি, তিনি তাঁর এমত গৃহ প্রত্যাবর্তনে খুশি হতে পারেন না। তিনি কি সত্যি নিজ গৃহ নির্মাণের জন্য আর একটি গৃহের ধ্বংস সাধনে সায় দিতে পারেন? হ্যাঁ, মসজিদকে তো আল্লার বাড়ি বলা হয়। সেই বাড়ি প্রায় তিন দশক আগে ভেঙেই তো ফেলা হয়েছিল। যে রামচন্দ্র পিতৃসত্য রক্ষার্থে পরম নির্মোহে ছেড়ে আসতে পারেন অসীম বৈভব ও বিস্তৃত সাম্রাজ্য, তিনি কি সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর নিজের জন্য এই বিপুলাকায় নির্মাণে আনন্দিত হতে পারেন? কেউ বলতেই পারেন (আদালতের রায়েও ইঙ্গিত আছে) যে পাঁচ শত বছর আগে এই ভূমি তাঁরই ছিল। কিন্তু ত্যাগ যাঁর স্বভাবগত, সেই পুরুষোত্তম রাম কি মসজিদের হাত থেকে এই ২.৭৭ একর জমি ফিরিয়ে নিয়ে সেখানে নিজ আলয় নির্মাণে খুব আগ্রহী হতেন? যিনি লঙ্কা জয়ের পর তা ছেড়ে আসেন, যিনি পরম সন্তোষে চীরবাস গ্রহণ করেন রাজবেশের স্থানে, ছিনিয়ে নেওয়া জমির উপর অট্টালিকা নির্মিত হলে সে স্থান যে তিনি পরিত্যাগ করতেন, তা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই আমার রাম এখন থেকে অধিষ্ঠান করবেন সর্বত্র, প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষুদ্র মন্দিরে, গেরস্থের ঘরের সিঁদুরমাখা কুলুঙ্গিতে, ব্যস্ত অনাবাসীর ল্যাপটপের স্ক্রিনে। রইবেন না শুধু সংখ্যার দম্ভ আর অর্থের শক্তিতে নির্মিত অযোধ্যার পেল্লায় মন্দিরে। আরও এক বার তাঁর নির্বাসন হল।

কেউ বলতেই পারেন যে আমার এই বিশ্বাস অবান্তর। মন্দির নির্মাণের পিছনের রাজনীতিটুকু আমি দেখতে পাচ্ছি না, দেখতে চাইছি না। তাঁরা আমাকে বোঝাতে পারেন মন্দির নির্মাণের প্রক্রিয়ার এই সূচনার মধ্য দিয়ে কী ভাবে পিছনে চলে গেল অতিমারি মোকাবিলায় সরকারি ব্যর্থতার খতিয়ান, কী ভাবে ভুলিয়ে দেওয়া গেল পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মন্তুদ হেঁটে চলার আখ্যান, দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া গেল দেশের বেহাল অর্থনীতি থেকে। এই সব জটিল রাজনীতির হিসেবনিকেশ জানা সত্ত্বেও আমি তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন করব আমার শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষ থেকেই। তিনি কি রাজনীতির হিসেব নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন কখনও? যদি হতেন, তবে সৎ-মা এবং কুচক্রী দাসীর ষড়যন্ত্র তিনি প্রতিহত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা না করে অনায়াসে ছেড়ে এসেছিলেন রাজ-ঐশ্বর্য।

এক বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম বারাণসী। গঙ্গাতীরে শ’খানেক উঁচু সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছেছিলাম ‘রামচরিতমানস’-এর রচয়িতা তুলসীদাসের ঘরে। সেই তুলসীদাস, যাঁর হাত ধরে সংস্কৃতের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রামায়ণ পৌঁছেছিল উত্তর ভারতের সাধারণ মানুষের নাগালে। অনেক নীচে নদীর জল অপরাহ্ণের আলোয় ঝলমল; সেখানে বাঁধা অলস ক’টি নৌকা। যেন দেখতে পেলাম সন্তসুলভ প্রশান্তি নিয়ে নিবিষ্ট মনে লিখছেন তুলসীদাস। রাম চলেছেন নির্বাসনে। সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে সঙ্গে যেতে চান সীতা, “সিয় মনু রাম চরণ অনুরাগা। ঘরুন সুমগু বনু বিষমু না লাগা”। সীতার মন রামের চরণে অনুরক্ত। তাই গৃহকে উত্তম, বনবাসকে বিষম বলে তাঁর মনে হয় না। তুলসীদাসের দু’চোখে দরবিগলিত ধারা। আমার প্রতীতি, রাজনীতির কোলাহল অতিক্রম করে সেই অশ্রু আবারও নির্গত হবে অবিরল ধারায়। শ্রীরামচন্দ্র আবারও চলেছেন নির্বাসনে, তাঁর ঠাঁই শুধু ভক্তের হৃদয়ে। বিপুল বৈভব ও শক্তির দম্ভে নির্মীয়মাণ কোনও রাজসিক মন্দিরে নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ram Mandir Ayodhya Bhumi Pujan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE