Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
New Education Policy

গরিবরা বরং হাতের কাজ শিখুক

এত অল্প বয়সে বৃত্তিমুখী শিক্ষার সূচনা করা হলে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে চিরতরে বেরিয়ে যাবে, এই আশঙ্কা বেশ তীব্র।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অভিরূপ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০৪
Share: Save:

সদ্য প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই ছাত্রছাত্রীরা বৃত্তিমুখী শিক্ষার পাঠ্যক্রম বেছে নিতে পারবে। একটি বারো বছরের শিশু কি পছন্দসই পেশা বেছে নিতে পারে? এত অল্প বয়সে বৃত্তিমুখী শিক্ষার সূচনা করা হলে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে চিরতরে বেরিয়ে যাবে, এই আশঙ্কা বেশ তীব্র। বিশেষত, দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা হয়তো তাদের পারিবারিক পেশাকেই বৃত্তি-প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নেবে। সেখানেই ফুরিয়ে যাবে তার অন্য যাবতীয় সম্ভাবনা— শিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে আর্থিক উন্নতির ধাপ পেরোনো, অন্য আর্থ-সামাজিক স্তরে পৌঁছতে পারা, যাকে বলে ‘মোবিলিটি’, বৃত্তিমুখী শিক্ষা তাতে পূর্ণচ্ছেদ বসিয়ে দিতে পারে।

ভারত দেশটি বৈষম্যে ভরপুর— অর্থনৈতিক বৈষম্য তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে আছে জাতিগত বৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি, যা থেকে জন্ম নেয় সুযোগের বৈষম্য। এইখানেই শিক্ষার মাহাত্ম্য। বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে এই অসাম্য দূর করার একমাত্র উপায় শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। কোনও পরিযায়ী শ্রমিককে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, তিনি তাঁর সন্তানের জন্য কেমন জীবন কল্পনা করেন, তা হলে নিশ্চয়ই উত্তর আসবে, যে দুর্ভোগ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে, সেটা যেন আর তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে সহ্য না করতে হয়। সেই কাজটা একমাত্র শিক্ষাই পারে। আর সেখানেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণের সূচনা এতটা গোলমেলে। কারণ উন্নততর আর্থিক অবস্থার স্বপ্ন দেখা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের।

যে মৌলিক অধিকারগুলি সকল মানুষ সমান ভাবে দাবি করতে পারেন, তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। এবং অন্যান্য যে কোনও অধিকারের মতোই সেই অধিকার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয় রাষ্ট্রকে। দেশের প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে দারিদ্র দূরীকরণকে লক্ষ্য হিসেবে না রেখে, অসাম্য কম করাকেই আদর্শ করা উচিত দেশের শিক্ষানীতির। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেন ঠিক উল্টোটাই হতে চলেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার বা গরিবের সন্তান যখন ওয়েল্ডিং-এর ভোকেশনাল ট্রেনিং নেবে, তখন হয়তো শহরের পাঁচতারা স্কুলে পড়া কোনও ছেলে বা মেয়ে করবে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর কোর্স।

কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কায়িক পরিশ্রম করে দু’পয়সা রোজগার করা যে অনেক বেশি কাম্য, সে কথা মোদী তাঁর ‘হার্ভার্ড’ বনাম ‘হার্ড ওয়ার্ক’ যুক্তি দিয়ে বেশ কিছু দিন আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সমর্থকরা হামেশাই কানহাইয়া কুমারকে কটূক্তি করে গিয়েছেন যে, কেন তিনি অন্য তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের মতো বাইশ বছর বয়স থেকে আয়কর দিচ্ছেন না। বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণ উচ্চশিক্ষার প্রতি বিরূপ মানসিকতাকেই আরও পোক্ত করবে।

এত কিছুর পরেও যদি কোনও গরিবের সন্তান কলেজ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাকে কিন্তু ভর্তি হতে হবে ‘গ্রেডেড অটোনমি’র বিচারে সবচেয়ে নীচের দিকে থাকা তৃতীয় শ্রেণির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটিতে। কারণ, শুধু সেগুলিই সাধারণ নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে, আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সবচেয়ে বেশি। প্রথম শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং যে সকল বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভারতে ক্যাম্পাস বানানোর সুযোগ দেওয়া হবে, সেই সব প্রতিষ্ঠান এই শ্রেণির মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। আবার সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কমন অ্যাডমিশন টেস্টের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করার হুকুম জারি হয়ে গেলে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার মতো প্রতিষ্ঠান নিজেদের মাপকাঠি দিয়ে ছাত্রছাত্রী বেছে নিতে পারবে না আর। অর্থাৎ ‘পজ়িটিভ ডিসক্রিমিনেশন’ হিসেবে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ছেলেমেয়েদের ভর্তি হওয়ার যে বিশেষ সুযোগ জেএনইউ দিয়ে এসেছে, তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে। এ ভাবেই সমাজের একটা বিশাল অংশ চিরতরে বেরিয়ে যাবে মূলধারা থেকে।

নতুন এই শিক্ষানীতি চালু হলে চার বছরের স্নাতক স্তরের যে কোনও সময় কোনও ছাত্র বা ছাত্রী লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেও ক্ষতি নেই, তাকে নিদেনপক্ষে একটি ডিপ্লোমা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। অতঃপর, মনের মতো পাত্র পেয়ে গেলেই অনায়াসে মেয়ের পড়াশুনো বন্ধ করে দিতে পারবেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা।

এর ফলে কর্মসংস্থানযোগ্যতা বাড়বে হয়তো, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর সুবিধাও পাওয়া যাবে, কিছু মানুষ হয়তো সত্যিই দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসবেন— কিন্তু সমাজের অসাম্যও বাড়বে। তথাকথিত নিচু জাতের মানুষ, যাঁরা নিজেরা নিরক্ষর হয়েও যৎসামান্য সঞ্চয়ের টাকা খরচ করে সন্তানকে পড়াচ্ছেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে যদি পড়াশোনা ছেড়েও দেয়, কিছু যাবে-আসবে না রাষ্ট্রের। দিন-আনি-দিন-খাই শ্রমিক-মজুরের সন্তান আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখবে না, সে স্বপ্ন তোলা থাকবে সমাজের ওপরের দিকের জন্য। বাবার মতো দুটো পয়সা রোজগার করার মতো অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষ শ্রমিক হতে পারলেই তারা ভাগ্যবান মনে করবে।

অরওয়েলীয় হিন্দু রাষ্ট্রের ‘আদর্শ’ নাগরিকের মানসিক গঠন এমন হতে হবে, যেন সে নিজের স্বাভাবিক অধিকারগুলিও রাষ্ট্রের কাছ থেকে দাবি করার কথা ভাবতে না শেখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

New Education Policy Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE