Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Vedas

বেদে মেলে প্রকৃতিরক্ষার বার্তা

প্রকৃতিকে ব্যবহার করো বন্ধুর মতো, শ্রদ্ধা করো মায়ের মতো, মেনে চলো বাবার মতো এবং পরিচর্যা করো শিশুর মতো। বৈদিক মন্ত্রে বলা রয়েছে, মানুষের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লিখছেন পলাশ গোস্বামীবেদে বর্ণিত আছে, প্রজাপতি ব্রহ্মা অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য মার্কণ্ডেয় মুনিকে দেবী দুর্গার ‘দেবীকবচম’-এর শ্লোক শোনান। এতে দেবী দুর্গার স্তুতি যেমন রয়েছে, তেমনই পরিবেশের আরাধনার কথাও বলা হয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৩৬
Share: Save:

বেদে বর্ণিত আছে, প্রজাপতি ব্রহ্মা অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য মার্কণ্ডেয় মুনিকে দেবী দুর্গার ‘দেবীকবচম’-এর শ্লোক শোনান। এতে দেবী দুর্গার স্তুতি যেমন রয়েছে, তেমনই পরিবেশের আরাধনার কথাও বলা হয়েছে। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে প্রকৃতি পুজো, পরিবেশ রক্ষা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনধারণের উল্লেখ রয়েছে। বৈদিক মন্ত্রে বলা রয়েছে, মানুষের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; তাই প্রকৃতিকে ব্যবহার করো বন্ধুর মতো, শ্রদ্ধা করো মায়ের মতো, মেনে চলো বাবার মতো এবং পরিচর্যা করো শিশুর মতো।

প্রকৃতিকে বাঁচানোর তাগিদে ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের প্রয়োজন উপলব্ধি করে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বৈদিক ঋষিরা পবিত্র শক্তিরূপে প্রকৃতিকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা আগেই জেনেছেন, পরিবেশের অপব্যবহার প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে। তার ফল অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অনিয়ন্ত্রিত বন্যা, মড়ক এবং জল, বাতাস ও মাটি দূষণ। তাই তাঁরা নদ-নদী, গাছ, পাহাড়, পশু, পাখি— প্রকৃতির সমস্ত কিছুকে পবিত্র সত্তা দান করেছেন। ঋগ্বেদে নদী নিয়ে গোটা স্তব (‘নদীস্তুতি সূক্ত’) যেমন রয়েছে, তেমনই অথর্ব বেদে আছে পৃথিবী বা মাটি সংরক্ষণের গানও (‘পৃথিবী সূক্ত’)।

আসলে গোটা অথর্ব বেদ জুড়েই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের ভরপুর বর্ণনা রয়েছে। যা কিছু স্বর্গীয় তারই পার্থিব রূপ হল প্রকৃতি। বেদে শুধু দেবদেবীদের নয়, প্রকৃতির সমস্ত উপাদানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ও অলৌকিক শক্তির আধার হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এ আসলে পরিবেশ বাঁচানোর কৌশল।

আসলে বৈদিক সাধনার মূল ভাব হল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপন, যা মানুষের পরিপূর্ণ চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। প্রকৃতি চেতনার মধ্য দিয়েই সর্বজন সুখের কথা বলা আছে—‘সর্বেপি সুখীনা সন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়/ সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু মা কশ্চিত্ দুখমপুন্যাত্।’ (সকলে সুখী হও, ভয়হীন হও, সবার ভাল হোক, কেউ যেন দুঃখ না পায়)।

পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রকৃতির মধ্যে থাকা জীববৈচিত্র্য ও স্থানবৈচিত্র্যও ধরা আছে প্রাচীন সাহিত্যে। এর সরল উদাহরণ হল দেবাদিদেব মহাদেব ও তাঁর পরিবার। শিবের নিবাস কৈলাসে। দুর্গম বরফঢাকা চূড়া, যা অনতিক্রম্য। শিবের মাথার চাঁদ শান্তির প্রতীক। পাহাড় এবং চাঁদ, পার্থিব ও মহাজাগতিক সম্পর্কের নির্দেশক। শিবের জটা থেকে নির্গত গঙ্গা হল পবিত্রতার প্রতীক এবং জল যে জীবন, এই চরম সত্য উপলব্ধি হয় গঙ্গার মর্ত্যে আগমনের মধ্যে দিয়েই। আবার, শিবের বাহন ষাঁড় হল ধৈর্যশীল প্রাণীজগতের প্রতিনিধি। প্রকৃতিতে বিষের উপস্থিতি জানান দেয় শিবের গলার সাপ, সরীসৃপ। দেবী পার্বতীর বাহন সিংহ হল বন্যপ্রাণের দ্যোতক। কার্তিকের বাহন ময়ূর পক্ষীজগতের দূত। গণেশের বাহন ইঁদুর তেমনই ছোট প্রাণী অথবা মাটির নিচের প্রাণীদের প্রতিনিধি। একই ভাবে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা নিশাচর শিকারি এবং সরস্বতীর হাঁস জল ও স্থলে বিচরণকারী উভচরকে নির্দেশ করে।

আশ্চর্যের বিষয়, শিবের রাজ্যে বিভিন্ন বন্ধু-শত্রু, খাদ্য-খাদক নিজেদের তাগিদে সহাবস্থান করছে। ময়ূর যেমন সাপের শত্রু, তেমনই ইঁদুর আবার সাপের খাদ্য, পেঁচারও। তাই শিবের বা তাঁর পরিবারের উপাসনা আসলে প্রকৃতিরই উপাসনা।

এখনও আমাদের সমাজে বিভিন্ন আচার-আচরণ প্রকৃতিকেন্দ্রিক। গ্রামে লৌকিক দেবদেবীর অধিষ্ঠান বড়, প্রাচীন গাছের তলায়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বেশির ভাগ মন্দিরের সামনে থাকে বাগান। প্রবল গ্রীষ্মে গাছে জল দেওয়ার আচার, তুলসীগাছে জল দেওয়ার রেওয়াজ কেবলমাত্র পুণ্য অর্জন করার জন্য যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি সংরক্ষণের জন্য। বেদের বিভিন্ন মন্ত্রেও উল্লেখ রয়েছে, পরিবেশকে বিরক্ত করা মানে প্রকৃতির রোষে পড়া, ভগবানের রোষে পড়া।

বেদ মানুষকে বারবার প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে বলেছে এবং এর মধ্যেই সংরক্ষণের বীজ পোঁতা আছে। সভ্যতার অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সেই জ্ঞানের অভাব যেমন চোখে পড়ছে, ভীতিজনক ভাবে তার বিকৃতি, অবলুপ্তিও ঘটে চলেছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ নষ্ট করার ফল আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি। লক্ষ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কয়েক যোজন বনাঞ্চল ও বাসস্থান ধ্বংস হয়েছে, মাটি-বাতাস-জল এখন দূষিত। মাত্রাহীন লোভ আর প্রকৃতির উপরে যথেচ্ছাচার মানুষকে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে।

চার বেদই প্রকৃতির চক্রকে সামঞ্জস্য রাখার কথা নিখুঁত ভাবে বলেছে। বলেছে মানুষের লোভ ও অবিমৃষ্যকারিতা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা এবং পতনের জন্য দায়ী। এটা আমাদের কাছে শিক্ষণীয় যে, আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে যত্ন সহকারে সংরক্ষণের মাধ্যমে বৈদিক মানুষজন প্রকৃতি ও পরিবেশকে পুজো করত। মেনে চলত—‘প্রকৃতির ক্ষতি করোনা; জল ও ফুলের ক্ষতি করোনা; মাটি আমার মা, আমি সন্তান; জল অপবিত্র (দূষিত) যেন না হয়; জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বায়ুতে ফসলে ফুলে-ফলে সমস্ত প্রাণে শান্তি বিরাজমান হোক।’ প্রাচীন বৈদিক প্রার্থনা প্রকৃতিরক্ষার এক অমূল্য পাঠ, যা সকলের মধ্যেই নিহিত থাকা প্রয়োজন, অন্তত নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে।

ইঁদপুরের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vedas Nature Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE