Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
কেনিয়ার লেখক নিপীড়িতের কথা বলছেন তাঁদেরই ভাষায়

যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক

গুগি শুধু আফ্রিকার নন, সারা পৃথিবীর নিজ ভাষা হারিয়ে ফেলা, ভাষা হারাতে বসা মানবজাতির কাছে এক দিগ্‌দর্শন। মাতৃভাষার দিকে ফেরার এক অনন্য কম্পাস।

দায়িত্ব: মাউ-মাউ বিদ্রোহের সময় ‘সন্দেহজনক’ হিসাবে গ্রেফতার হাজারে-হাজারে মানুষ। কে বলবে এঁদের কথা? ছবি: গেটি ইমেজেস

দায়িত্ব: মাউ-মাউ বিদ্রোহের সময় ‘সন্দেহজনক’ হিসাবে গ্রেফতার হাজারে-হাজারে মানুষ। কে বলবে এঁদের কথা? ছবি: গেটি ইমেজেস

ঈপ্সিতা হালদার
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

গুগি ওয়া থিয়োং’ও। কেনিয়ার প্রবাদপ্রতিম লেখক, নাট্যকার ও সংগ্রামী। আফ্রিকার বিভিন্ন ভাষাভাষী অসংখ্য মানুষ, যাঁরা নিজের কথাটা বলতে পারছেন না, বলতে দেওয়া হচ্ছে না— আজ তাঁদের সবার কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়িয়েছেন এই লেখক। যিনি কেনিয়ার মানুষের ওপর বিকট ঔপনিবেশিক অত্যাচার দেখেছেন, তা নিয়ে লিখেছেন। তার পর তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন, স্বাধীন দেশে প্রভু হয়ে বসা স্বদেশি লোকও কী ভাবে স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি আর ভ্রষ্টাচার কায়েম করতে পারে। সে জন্য লেখক জেলে গিয়েছেন, দেশান্তরিত হয়েছেন। ইংরেজিতে লেখা ছেড়ে, নিজের গোষ্ঠীর ভাষা ‘গিকুয়ু’তে নতুন রকমের গদ্যে লিখেছেন আফ্রিকার নানাস্তরী ইতিহাস। লিখেছেন আফ্রিকার এখনকার শঙ্কা-স্বপ্নগুলি। আজ গুগি শুধু আফ্রিকার নন, সারা পৃথিবীর নিজ ভাষা হারিয়ে ফেলা, ভাষা হারাতে বসা মানবজাতির কাছে এক দিগ্‌দর্শন। মাতৃভাষার দিকে ফেরার এক অনন্য কম্পাস।

যিনি তাঁর ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড (১৯৮৬) বইতে বললেন, খাতায়-কলমে স্বাধীনতা পেলেই হয় না, দরকার বি-উপনিবেশীকরণের। ঔপনিবেশিক প্রভুর কাছে বাঁধা দেওয়া মনকে ছাড়িয়ে নিতে হয়। অত্যাচারে হারিয়ে যাওয়া নিজের ইতিহাসকে খুঁড়ে তুলতে হয়। মরে যাওয়া বা আঘাতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া মাতৃভাষাকে আবার জাগাতে হয়। তার পর সেই ভাষায় নিজের গোষ্ঠীর জ্ঞানকে ফিরে তৈরি করতে হয়। এ-সব কাজ খুবই কঠিন। আরও কঠিন, যদি এগুলি করতে হয়, ইউরোপের তৈরি আধুনিকতার ধারণার তোয়াক্কা না করে। গুগি সেই দুরূহ পথে সন্ধান করছেন আফ্রিকার চেতনা ও স্বর। মনে রাখতে হবে, ইংরিজি বা ফরাসিতে লেখা ঔপনিবেশিক বয়ানে, কালো মানুষের চেতনাকে হীন নীচ জন্তুসম বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে ‘আধুনিক’ বলতে বোঝায় শুধু পশ্চিমি মূল্যবোধগুলিই। গুগি নোবেল পাননি এখনও। নাইজিরিয়ার চিনুয়া আচেবে যেমন পাননি।

জেমস গুগি নামে তাঁর তিনটে উপন্যাস ছাপা হয়ে গিয়েছিল ইংরেজিতে। ইংরেজি ভাষার পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে উইপ নট, চাইল্ড-এ বিধৃত মাউ-মাউ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত। সশস্ত্র মাউ-মাউ বিদ্রোহকে ধ্বংস করা হয়েছিল, কেনিয়ার গ্রামের পর গ্রাম, বহু মানুষের প্রাণ নাশ হয়েছিল। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে গুগির মনে হয়েছিল, নাম ভুলিয়ে দেওয়াই উপনিবেশিক শক্তির সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। গোষ্ঠীনামের বদলে খ্রিস্টীয় নাম চাপিয়ে দেওয়া, সহস্র আফ্রিকাবাসীকে জাহাজের খোলে পুরে গনগনে সিলে গা পুড়িয়ে ক্রীতদাস হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া— গুগি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, ফিরে যান দেশজ নামে: গুগি ওয়া থিয়োং’ও। মানে: থিয়োং’ও-র ছেলে গুগি।

১৯৭৭-এ গুগি সিদ্ধান্ত নেন, ইংরেজির বদলে গিকুয়ুতে লেখার, যে ভাষায় লিখলে তাঁর মা আর দেশসুদ্ধ জনগণ পড়তে পারবেন তাঁর লেখা। তার আগেই অবশ্য, ১৯৬৮ সালে, তিনি এক যুগান্তকারী প্রস্তাব আনেন— নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগকে রদ করে, আফ্রিকার ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব পড়ানোর জন্য ‘সাহিত্যের বিভাগ’ খোলা হোক। এই তর্ক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে: সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্রে কেন ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যকে সব সময় রাখা হবে কেন্দ্রে? ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে যুক্তি মেনে, কেন তাকে দেওয়া হবে সেরা সাহিত্যের শিরোপা, যখন সারা পৃথিবীতে এত ভাষা, এত সাহিত্য তাদের নিজ চমৎকারিত্বে ঝলমল করছে?

গুগি ওয়া থিয়োং’ও।

গুগি নিউ ইয়র্কে সাহিত্যিক সম্মেলনে গিয়ে শোনেন, এক ইতালীয় লেখক বলছেন, ইতালিয়ান ভাষা তো আর আফ্রিকার ‘বানটু’ ভাষা নয় যে তাতে দু’তিনটে মাত্র শব্দ আছে! গুগির ভাষা গিকুয়ু হল বানটু ভাষা-পরিবারের অন্তর্গত। গুগির মনে হল, আফ্রিকার একটি ভাষা সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনে, এক ইউরোপীয় এমন একটা অপমানজনক কথা বলে দিলেন! তার পর গুগি ভাবতে লাগলেন, আফ্রিকার সাহিত্য কি শুধু ইউরোপীয় ভাষাতেই রচিত হতে হবে? কারা তা পড়বে, আর কারা পড়তে পারবে না? তা কী করেই বা হয়ে উঠবে আধুনিকতার অঙ্গ?

এই বার, কেনিয়ার কামিরিথু গ্রামের মানুষদের নিয়ে, গুগি তৈরি করলেন ওপেন এয়ার থিয়েটার। নাটক লেখা হল গিকুয়ু ভাষায়। লোকের মুখের কথা, লব্‌জ, রগড়, নাচাগানা নিয়ে এনগাহিকা এনদিন্দা, ‘আমার যখন খুশি তখন বিয়ে করব’ (১৯৭৭) প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আপাত ভাবে, স্বাধীন কেনিয়ার গণসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জাতীয় প্রকল্পে কামিরিথু থিয়েটার খাপে-খাপে পড়ে গেলেও, কর্তৃপক্ষের টনক অন্য ভাবে নড়ল। কারণ এই নাটকে স্বাধীন কেনিয়ার নব্য প্রভু হয়ে বসা নেতাদের দুর্নীতির নিন্দে করা হচ্ছিল, দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে আঙুল দেখানো হচ্ছিল। উপরাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল আরাপ মোই-এর নির্দেশে পুলিশ গভীর রাত্রে হানা দিয়ে তুলে আনল গুগিকে।

কোনও মামলা ছাড়াই গুগি জেলে আটক থাকলেন এক বছর। গার্ডদের থেকে পেন চুরি করে টয়লেট পেপারের ওপর লিখলেন গিকুয়ুতে প্রথম উপন্যাস: কাইতানি মুথারাবা-ইনি, ক্রসকাঠে শয়তান (১৯৮০)। দেখালেন, স্বাধীন কেনিয়া কী ভাবে বিকিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির কাছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর হস্তক্ষেপে জেল থেকে বেরলেন বটে, কিন্তু তার পরেই রাষ্ট্রের অত্যাচারে তাঁকে পরিবারসহ যেতে হল আমেরিকায়, নির্বাসনে। দীর্ঘ নির্বাসনে গুগি অজস্র রাজনৈতিক সন্দর্ভ লেখেন, নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ান। দেশে ফিরতে পারেন ২২ বছর পর, আরাপ মোই যখন ক্ষমতাচ্যুত হলেন। কিন্তু আরাপ মোই মানে তো একা ব্যক্তি নয়, একটি নষ্ট ব্যবস্থা। তাই কেনিয়ায় ফেরামাত্র গভীর রাতে দুষ্কৃতীরা গুগির বাড়ি ভাঙচুর করে, তিনি শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হন, তাঁর স্ত্রীকে যৌন হেনস্তা করা হয়। চিরতরে আফ্রিকা ছাড়তে হয় গুগিকে।

ভারত সফরে এসে ‘সিগাল ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস’-এর আমন্ত্রণে সদ্য কলকাতা ঘুরে গেলেন গুগি। জন নাট্য মঞ্চের সুধন্য দেশপান্ডের সঙ্গে আলাপচারিতায় মনে করিয়ে দিলেন, কী ভাবে গল্পকার আর কথকই পারেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বলে যেতে। আর যখন বিরোধিতা প্রবল, কী ভাবে অক্ষমতার অন্ধকারকেই হাতিয়ার করে নিতে হয় প্রতিরোধের। পেনই তখন বেয়নেট। আর ‘বুলেট গেয়ে ওঠে গান’। রূপক, তির্যক প্রতীক হয়ে ওঠে হাতিয়ার। তাঁর শেষ উপন্যাস মুরোগি ওয়া কাগোগো, ‘কাকদেশের ভানুমতী’ (২০০৬) তাই হয়ে ওঠে কল্পজগতের এক স্বৈরাচারী শাসককে নিয়ে লেখা শ্লেষ-রগড়। যে কেউ নিজের দেশের রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে সেই কাহনকে।

গুগি বলেছিলেন, লিখব নিজ মাতৃভাষায়, আর এক ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার হাতে হাত ধরিয়ে দেবে অনুবাদ, তাকে ভরসা করব। ত্রিশটির ওপর ভাষায় অনূদিত হয়েছেন গুগি। যিনি সাহিত্যিক হয়ে উঠতে গিয়ে তোয়াক্কা করেননি ক্ষমতার ভাষাকে, তিনি নোবেল পেলেন কি না, তা নিয়ে আমরা এত চিন্তিত কেন? কারণ গিকুয়ুতে কথা বলেন কেনিয়া নামে আফ্রিকার একটা দেশের মাত্র ২২% মানুষ— কিকুয়ু নামে এক জনগোষ্ঠী। সেই ভাষায় লিখে কেউ নোবেল পেলে, এটা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে আফ্রিকার যন্ত্রণা ও প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা সর্বজনীন, তার স্বপ্ননির্মাণের হক আছে, আর তাতে হক আছে পৃথিবীর মানুষের। স্বীকার করা হয়, দুঃখিনী মাতৃভাষাকে রাজনীতির অস্ত্র করা যায়, দায়িত্ব নেওয়া যায় নিজ জনগোষ্ঠীর মর্যাদা নির্মাণে।

তাতে ভারতেরও জেগে ওঠার সম্ভাবনা আছে। বাংলারও। হাজার মাতৃভাষার দেশ আমাদের, আমরা যে খুব একটা মর্যাদা দিইনি অন্যের ভাষাকে, ছোট-ছোট গোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে, আজ নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষাকে ভুলতে উঠে-পড়ে লেগেছি, তৈরি করেছি এক অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে অন্য অঞ্চলের বিরোধ ও আধিপত্যের খেলা, সে-কথা মনে পড়ে যায়। গুগি তাই শুধু আফ্রিকার নন, আমাদেরও কথা বলে চলেন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE