Advertisement
১১ মে ২০২৪

গোলাপি বলে আজ ইতিহাস লেখা হবে ইডেন গার্ডেন্সে

এই গোলাপি বল লাল বা সাদা বলের মতোই তৈরি হয় কর্ক উল ও চামড়া দিয়ে। এই রঙের বলের উজ্জ্বলতা ও সিম লাল বা সাদা বলের থেকে কিছুটা আলাদা হয়। ফলে, ফ্লাডলাইটে এটি দেখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি। লিখছেন অর্ণবকুমার রায়ভারত এবং বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হল ক্রিকেট। অনেকে মনে করেন, শিশুদের খেলা হিসেবে ক্রিকেটের উদ্ভব। তখন এর সরঞ্জাম ছিল লাঠি আর ভেড়ার পশম থেকে তৈরি বল।

গোলাপি বল হাতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

গোলাপি বল হাতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

কত ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে ইডেন গার্ডেন্স। আজ দুপুরে আর এক ইতিহাস তৈরি হবে সেখানে। কয়েক ঘণ্টা পরে শুরু হবে গোলাপি বলে ভারতের প্রথম দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে ভরে উঠবে ক্রিকেটের এই নন্দনকানন।

ভারত এবং বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হল ক্রিকেট। অনেকে মনে করেন, শিশুদের খেলা হিসেবে ক্রিকেটের উদ্ভব। তখন এর সরঞ্জাম ছিল লাঠি আর ভেড়ার পশম থেকে তৈরি বল। ষোড়শ শতকের প্রথম ক্রিকেট খেলার অস্তিত্ব জানাতে পারা যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়েছিল ১৮৭৭ সালে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, আঠারো শতকে ভারতে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন এক ইওরোপীয় নাবিক। ১৭৯২ সালে কলকাতায় ভারতের প্রথম ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত টেস্ট ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ১৯৩২ সালের ২৫ জুন। ক্রিকেটের অন্য ফর্ম্যাট, ওয়ান-ডে খেলা শুরু হয়েছে সত্তরের দশকে। ভারত প্রথম এক দিনের ক্রিকেট খেলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই সময়ে।

কিন্তু ক্রিকেট খেলাই হবে না যদি না বল থাকে। আর এই বলের ইতিহাস নিয়ে অনেকেরই কৌতুহল রয়েছে। ক্রিকেটের বল কিন্তু পুরোপুরি গোল নয়। এর এক দিকের পরিধি ২২৪ মিলিমিটার আর অন্য দিকের পরিধি ২২৯ মিলিমিটার। তবে সব বলের ওজন ১৫৫.৯ গ্রাম থেকে ১৬৩ গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। মহিলাদের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে বলের ওজন ১৪০ থেকে ১৫১ গ্রাম।

বর্তমানে ক্রিকেট খেলার জন্য ইংল্যান্ডের ডিউক, অস্ট্রেলিয়ার কোকাবুরা আর ভারতের এসজি-র বল ব্যবহার করা হয়। এই তিন সংস্থার মধ্যে কোকাবুরা বলই বেশি ব্যবহার করা হয়। টেস্ট ম্যাচের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের বল দিয়ে খেলা হয়। ইংল্যান্ডে টেস্ট ম্যাচ হয় ডিউক বলে এবং অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ অফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজে ব্যবহৃত হয় কোকাবুরা। ভারতে টেস্ট ম্যাচগুলিতে খেলা হয় দেশীয় সংস্থা এসজি-র বলে। প্রথমে টেস্ট বা ওয়ান-ডে ক্রিকেট লাল বলে খেলা হত। পরে সত্তরের দশকের শেষ দিকে যখন দিন-রাতের আন্তর্জাতিক ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলা শুরু হল তখন থেকে সাদা বলের ব্যবহার শুরু হল। কারণ, রাতে ফ্লাডলাইটের আলোয় লাল বলকে সহজে দেখা যায় না। তাই অন্য রঙের বলের খোঁজ শুরু হয়। হলুদ ও কমলা রঙের বল দিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে খেলা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সাদা রঙকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল।

অনেকে দেখে থাকবেন টেস্ট চলতে চলতে বল পরিবর্তন করা হয়। আসলে বলের আকারে পরিবর্তন হয় বলে বল পরিবর্তন করা হয়। কখন বল পরিবর্তন হবে তা খেলার ফলাফলের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। বল তৈরির প্রক্রিয়া বেশ চমকপ্রদ। ন’টি থেকে দশটি ধাপ অতিক্রম করে একটি বল তৈরি হয়। গাছের কাঠ ও প্লাস্টিক দিয়ে বলের ভিতরের অংশ বা কোর তৈরি হয়। প্লাস্টিকের বলের উপরে কর্ক কাঠের টুকরো রেখে ভিজে উল (‘মেরিনো উল’) দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে বাঁধাই করে গোলাকৃতি করে দেওয়া হয়। এটা বেশ কিছু সময় ধরে শুকনো হয়। এটি যত শুকোবে বল তত মজবুত ও উৎকৃষ্ট হবে। অন্য দিকে অবশ্য বলের খোল বানানোর কাজ চলে।

খোলের চামড়া দক্ষ কর্মচারীরা কাটিং করেন। একটা বলের জন্য চার টুকরো চামড়া লাগে। দু’টি করে চামড়ার টুকরো জুড়ে ‘স্টিচ’ করে দেওয়া হয়। এর পরে যন্ত্রের সাহায্যে গোলাকার রূপ দেওয়া হয়। দু’দিকের অর্ধগোল খোলের মাঝে কোর অংশটি ভরা হয়। এবং অক্ষরেখা বরাবর এক বিশেষ ধরনের সুতো দিয়ে সেলাই করে জোড়া হয়। এই প্রথম সেলাইটি হয় ঊর্ধোত্থিত। এটি অনেকটা ঠোঁটের মতো দেখতে। তাই একে ‘লিপ স্টিচিং’ বলে। এর পর, মোম পালিশ করা হয় এবং হিটারে সেঁকা হয়। ‘লিপ স্টিচিং’ ছাড়াও এর দু’পাশে দু’টি করে সেলাই দেওয়া হয়। এই অংশটিকে ‘সিম’ বলে। দ্বিতীয় পর্যায়ের সেলাইয়ের পরে বলের উপরে সোনালি রঙে সংস্থার স্ট্যাম্প দেওয়া হয়। শেষে আর এক বার পালিশ করা হয়। চামড়ার আবরণের জন্য একে ‘লেদার বল’-ও বলা হয়ে থাকে। এ ভাবেই ভারতে এসজি সংস্থা বল তৈরি করে। অন্য দু’টি কোম্পানির বল তৈরির প্রক্রিয়া অনেকটা একই রকম।

ভারতে এত দিন লাল ও সাদা রঙের বল ব্যবহার করা হচ্ছিল। তবে আজ কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে প্রথম বারের জন্য দিন রাতের টেস্ট খেলা হতে চলেছে গোলাপি বলে। নব নির্বাচিত ভারতীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই টেস্টের জন্য গোলাপি বল তৈরি করেছে ভারতীয় সংস্থা এসজি। অর্ডার দেওয়া হয়েছে ছ’ডজন বলের। তবে কয়েক বছর আগেই দিন রাতের টেস্টের জন্য এই গোলাপি বলের ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বহু পরীক্ষার পরেই গোলাপি রঙকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আইসিসি-র দাবি, ফ্লাডলাইটে গোলাপি রঙের বল দেখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অন্য রঙের ক্ষেত্রে দৃষ্টিবিভ্রম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া, এই

গোলাপি রঙের বল ক্যামেরায় দেখতে অসুবিধা হবে না। বলের উপরে গোলাপি রঙের শেড বা মাত্রা কতটা দেওয়া হবে তা চূড়ান্ত করার আগে ১৬ ধরনের শেড নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল।

ভারতে প্রথম হলেও গোলাপি বলে এর মধ্যেই ১১ আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে। গোলাপি বলে প্রথম টেস্ট খেলা হয়েছিল ২০১৫ সালে ২৭ নভেম্বর। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে এই খেলা হয়। এই খেলায় অস্ট্রেলিয়া তিন উইকেটে জেতে। এই গোলাপি বল লাল বা সাদা বলের মতোই তৈরি হয় কর্ক উল ও চামড়া দিয়ে। এই রঙের বলের উজ্জ্বলতা ও সিম লাল বা সাদা বলের থেকে কিছুটা আলাদা হয়। ফলে, ফ্লাডলাইটে এটি দেখতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি। এই বলের প্রকৃতি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, প্রথম দশ ওভার সুইং বেশি থাকবে এবং সিম নরম হয়ে গেলে ব্যাটসম্যানদের পক্ষে খেলা সহজ হবে। স্পিনারেরা এই বলকে বেশি টার্ন করাতে পারবেন না বলেই শোনা যাচ্ছে। তবে দেখা গিয়েছে সন্ধ্যার দিকে এই বল বেশি সুইং করে। এক বাঙালির তত্ত্বাবধানে আজ ইডেনে এই ইতিহাস লেখা হচ্ছে। বাঙালি হিসেবে এটাই বড় কম প্রাপ্তি নয়!

লেখক আঝাপুর হাইস্কুলের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE